বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় বর্ষাকাল আসছে আরও বেশি বৃষ্টি, আরও বেশি বিপদ নিয়ে। সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশবিজ্ঞানীরাও বলছেন, এদেশেও বর্ষাকাল বদলে যাচ্ছে। আগে বর্ষাকাল একটা সাইকেল বা চক্র মেনে চলত। এখন সেটা দেখা যাচ্ছে না।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের মাত্রার সঙ্গে এখানকার বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতির যোগসূত্র রয়েছে। শুরু থেকেই জলবায়ুগতভাবে অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে পৃথিবী। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে উপমহাদেশের জলবায়ুও।
গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, গত নয় লাখ বছর ধরে এখানে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের মাত্রা অনেকটাই নির্ভর করেছে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি, পৃথিবীতে বরফের উপস্থিতি, আবহাওয়ার স্যাঁতসেঁতে ভাব, ভারত মহাসাগর থেকে ভেসে আসা আর্দ্রতা ও দক্ষিণ গোলার্ধ্বের ভূগঠনের ওপর। এর ভিত্তিতে সম্ভাব্য জলবায়ু মডেল তৈরি করে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সামনের দিনগুলোয় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ডি ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওসায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক স্টিফেন ক্লিমেন্স জানান, এ গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা গত নয় লাখ বছরের বিভিন্ন সময়ে এ অঞ্চলে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণের হেরফের বিশ্লেষণ করে দেখেন। একই সঙ্গে তারা এ সময় বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও পৃথিবীতে বরফের উপস্থিতি এবং ভারত মহাসাগর থেকে ভেসে আসা আর্দ্রতার মাত্রাও বিশ্লেষণ করে দেখেন। বিশ্লেষণে দক্ষিণ এশিয়ায় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের মাত্রার সঙ্গে আবহাওয়াগত এসব উপাদানের সংযোগ খুঁজে পান বিজ্ঞানীরা।
স্টিফেন ক্লিমেন্স বলেন, এ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, অতীতেও বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ও এর প্রভাবজনিত উষ্ণায়ন মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে। সামনের বছরগুলোয় বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে এ অঞ্চলে মৌসুমি বৃষ্টিপাত বাড়বে বলে বিভিন্ন আবহাওয়া মডেলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। আমাদের গবেষণায় উঠে আসা ফলাফলও এসব পূর্বাভাসেরই সমর্থন করছে।
ক্লিমেন্সের মতে, পৃথিবীর আবহাওয়ায় জলকেন্দ্রিকতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন হলো দক্ষিণ এশিয়ার মৌসুমি বৃষ্টিপাত। এ অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে গ্রীষ্মকালে বৃষ্টিপাত কয়েক মিটারও ছাড়িয়ে যায়। এখানকার কৃষি ও অর্থনীতির জন্য বৃষ্টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ বৃষ্টিপাত মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে বন্যা ও ফসলহানির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এ অঞ্চলে কৃষিকাজ করে জীবন নির্বাহ করছে প্রায় ১৪০ কোটি মানুষ। ফলে তাদের জীবন-জীবিকার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব খতিয়ে দেখার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
বেশ কয়েক বছর ধরেই মৌসুমি বৃষ্টিপাতের নিয়ামকগুলো নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক একদল গবেষকের সঙ্গে কাজ করছেন ক্লিমেন্স। ২০১৪ সালের নভেম্বরে বঙ্গোপসাগরে গবেষণা জাহাজ জয়েডস রেজল্যুশনে চড়ে তারা অনুসন্ধান চালান। এ অনুসন্ধান কার্যক্রমের আওতায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পলির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এসব নমুনায় গত কয়েক লাখ বছরের মৌসুমি বৃষ্টিপাতের তথ্য সংরক্ষিত রয়েছে।
প্রতি বছর উপমহাদেশের মৌসুমি বায়ুজনিত বৃষ্টির পানির বড় একটি অংশ এসে জমা হয় বঙ্গোপসাগরে। ভূ-উপরিভাগ থেকে আসা এ পানি সাগরের নোনাপানির সঙ্গে মিশে তুলনামূলক পাতলা একটি স্তর তৈরি করে। পাতলা এ স্তর থাকে সাগরের উপরিভাগে। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি লবণাক্ততা ও ঘনত্বের পানি থাকে তলদেশে।
সাগরের পানিতে প্ল্যাংটোনিক ফোরামিনিফেরা নামে এক ধরনের অতিক্ষুদ্র অণুজীব পাওয়া যায়। পানি থেকে নেয়া পুষ্টিকে কাজে লাগিয়ে এসব অণুজীবের দেহে এক ধরনের খোলস তৈরি হয়। এ খোলসের প্রধান উপাদান হলো ক্যালসিয়াম কার্বোনেট। অণুজীবটির মৃত্যুর পর এ খোলস ডুবে যায় এবং তলদেশের পলিতে আটকা পড়ে।
গবেষণার জন্য বিজ্ঞানীরা এসব পলির নমুনা নিয়ে সেখান থেকে অণুজীবগুলোর ফসিল সংগ্রহ করেন। এরপর এগুলোর অক্সিজেন আইসোটোপ বিশ্লেষণ করে দেখেন গবেষকরা। এর বিশ্লেষণের ফলে তাদের পক্ষে অনুমান করা সম্ভব হয়, জীবিতাবস্থায় এসব অণুজীব কতটা নোনা ও ঘন পানিতে বসবাস করেছে। এ লবণাক্ততা নির্ণয়ের মাধ্যমে বিজ্ঞানীদের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে ঘটা বৃষ্টিপাতের মাত্রা সম্পর্কেও জানা সম্ভব হয়।
ফোরামিনিফেরা ছাড়া অন্যান্য উৎস থেকেও বিভিন্ন সময়ে বৃষ্টিপাতের মাত্রা সম্পর্কে তথ্য বের করার উপায় রয়েছে বিজ্ঞানীদের। এর অন্যতম হলো মূল ভূখণ্ড থেকে আসা নদীর পানিবাহিত পলি।
সাগরের তলদেশে এসব পলির সঙ্গে আসা উদ্ভিদ বা উদ্ভিদকণার জীবাশ্মের কার্বন বিশ্লেষণের মাধ্যমেও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন সম্পর্কে তথ্য বের করা সম্ভব। বৃষ্টিপাতের মাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গাছের পাতার মোমজাতীয় আবরণের হাইড্রোজেন আইসোটপিক কম্পোজিশনেরও পরিবর্তন হয়। এর নমুনাও সাগরের তলদেশের পলিতে খুঁজে পাওয়া যায়।
গবেষকরা দেখতে পান, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি ও বিশ্বব্যাপী বরফের পরিমাণ হ্রাসের ধারাবাহিকতায় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেড়েছে। এছাড়া পৃথিবীর কক্ষপথে সাময়িক পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন গোলার্ধ্বে সূর্যরশ্মির তীব্রতায়ও পরিবর্তন এসেছে। তবে এর মধ্যে কোনোটিকেই বৃষ্টিপাতের মাত্রা বদলের কারণ হিসেবে এককভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে বিষয়গুলোকে এক করে বিশ্লেষণের পরেও দেখা যাচ্ছে, মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণের সঙ্গে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধিজনিত উষ্ণায়নের এক ধরনের সংযোগ রয়েছে।
স্টিফেন ক্লিমেন্স বলেন, জলবায়ু মডেলগুলো আমাদের বলছে, উষ্ণায়িত পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও হয় বেশি। সাধারণভাবে বলতে গেলে, এখন যেসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়, সেগুলোয় ভবিষ্যতে বৃষ্টিপাত হবে আরো বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে আমরা এ ভবিষ্যৎই দেখতে পাচ্ছি।
এই গবেষণা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, কখনও হঠাৎ ভারি বর্ষণ আবার কখনও প্রকৃতি উষ্ণ হয়ে উঠছে। এখন প্রতিদিন যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে, এটা কাছাকাছি অন্যান্য কয়েক বছরে দেখা যায়নি। গত কয়েক বছর ধরে আবহাওয়া স্বাভাবিক আচরণ করছে না। এর কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। আবার বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশেও বর্ষা তার রূপ বদলাতে পারে। অতিবর্ষণ হতে পারে। এতে বিপদ বাড়তে পারে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বর্তমানকে জানতে হলে অতীতকে জানতে হবে। আমাদের ছয়টি ঋতু ছিল। সেখান থেকে চারটি ঋতুতে চলে আসছে। বৃষ্টিপাতের মৌসুম দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে দু’বার বৃষ্টি হয়েছে, যা অস্বাভাবিক। যখন থেকে বর্ষা শুরু হওয়ার কথা তার পরে শুরু হচ্ছে। আবার যখন শেষ হওয়ার কথা তার অনেক পরে শেষ হচ্ছে। অল্প সময়ে খুব বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। আগে পুরো চার মাস ধরে বৃষ্টি হতো। একটা সাইকেল ছিল। এখন বৃষ্টিপাতের কোনো সাইকেল নেই।
তিনি বলেন, বৃষ্টিপাতের এমন অস্বাভাবিক আচরণের কারণে কিছু বিপদ হচ্ছে। বর্ষা নিয়ে গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশও বর্ষা যদি ভয়ংকর রূপ ধারণ করে, তাহলে ক্ষতির চেয়ে বাংলাদেশ লাভই বেশি হবে। কারণ বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নাব্য হারানো নদীগুলো জীবন ফিরে পাবে। খনন করে নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনা পৃথিবীর কোথাও নেই। উপকূলে খরাসহ নানা কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃষ্টিতে স্বাদু পানি বাড়লে লবনের পরিমাণ কমে যাবে।
নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও পুনরুদ্ধার হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ভূগর্ভের পানির চাহিদা কমানো যাবে। সরকারকে এখন থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে।অতিবৃষ্টির কারণে বন্যার আশঙ্কা প্রকাশ করলেও এ গবেষক বলেন, প্রযুক্তি এখন অনেক উন্নত হয়েছে। আগাম পূর্ভাবাস দিয়ে ক্ষতি কমিয়ে আনতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৩১৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ