চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা উত্তেজনা বর্তমানে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। চীন গণতান্ত্রিক এই ভূখণ্ডকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে থাকে। সম্প্রতি তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা অঞ্চলে চীনের সামরিক বিমানের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় উত্তেজনার পারদ এখন চরমে।
বেইজিংয়ের এক কর্মকর্তা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, তাইওয়ান স্বাধীনতার দিকে আগালে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেবে চীন।
গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত তাইওয়ানকে নিজেদের অঞ্চল বলে দাবি করে চীন। অঞ্চলটিতে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে গত দুই বছরে কূটনৈতিক ও সামরিক চাপ জোরালো করেছে চীন। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে তাইপে। উদ্বেগ জানিয়েছে ওয়াশিংটন।
চীনের তাইওয়ান বিষয়ক কার্যালয়ের মুখপাত্র মা জিয়াওগুয়াং বলেছেন, চীন শান্তিপূর্ণভাবে তাইওয়ানের পুনরেকত্রীকরণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা নিয়ে রেড লাইন অতিক্রম করলে ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, ‘তাইওয়ানের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি যদি স্বাধীনতার উস্কানি দেয়, রেড লাইন অতিক্রমের চেষ্টা করে তাহলে আমাদের চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
আগামী ২০২২ সালে তাইওয়ান ইস্যু আরও জটিল রূপ নিতে পারে বলে সতর্কবার্তাও দিয়েছেন তিনি।
তাইওয়ানকে ঘিরে গত কয়েক বছর ধরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের উত্তরোত্তর অবনতি ঘটছে। আনুষ্ঠানিক কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রই তাইওয়ানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষক ও অস্ত্র সরবরাহকারী।
বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বহিরাগত শক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করে মা শিয়াওগুয়াং বলেন, ‘আমাদের কাছে থাকা খবর অনুযায়ী, বহিরাগত শক্তি সামনের মাসগুলোতে তাইওয়ান ইস্যুতে বেশ কিছু উস্কানিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে।’
‘আমরা বলে দিতে চাই, চীনও চুপচাপ বসে থাকবে না। বহিরাগত শক্তির উদ্দেশ্য আমরা বলতে চাই, যদি তারা তাদের পরিকল্পনা থেকে সরে না আসে, সেক্ষেত্রে সামনের বছর তাইওয়ান ইস্যু আরও জটিল ও ভয়াবহ রূপ নেবে।’
আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও তাইওয়ানের মূল আন্তর্জাতিক সমর্থক এবং অস্ত্র সরবরাহকারী যুক্তরাষ্ট্র। চীন নিয়মিতভাবে বলে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইস্যু হলো তাইওয়ান।
মা জিয়াওগুয়াং বলেন, সামনের মাসগুলোতে স্বাধীনতাপন্থী শক্তির উস্কানি এবং বাইরের হস্তক্ষেপ বাড়তে পারে এবং আরও তীব্র হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আগামী বছর তাইওয়ান উপত্যকার পরিস্থিতি আরও জটিল ও তীব্র হয়ে পড়বে।’
তাইওয়ানের ওপর চাপ বাড়াতে গত কয়েক মাসে বারবার বিমান মহড়া চালিয়েছে বেইজিং। তবে তারা হুমকি দিতে এগুলো পাঠানোর কথা অস্বীকার করেছে।
গত ১৫ নভেম্বর ভার্চুয়াল মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। দুই দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্য, জলবায়ু, জিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার পরিস্থিতি, তাইওয়ানের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হয় দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে।
এসব ইস্যুর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ইস্যু ছিল তাইওয়ানের স্বাধীনতা সংগ্রাম, যাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা’ বলে উল্লেখ করে আসছে চীন এবং অভিযোগ করে আসছে—যুক্তরাষ্ট্র নানা কৌশলে এই ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতাকে’ মদত দিচ্ছে।
বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে সতর্ক করে বলেন, তাইওয়ানের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতাকে’ মদত দেওয়া ‘আগুন নিয়ে খেলা’ করার মতো ব্যাপার এবং এটি অব্যাহত রাখলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘হাত পুড়বে’।
জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, তাইওয়ানের সঙ্গে যে যুক্তরাষ্ট্রের যে চুক্তি রয়েছে, তা-ই মেনে চলতে ইচ্ছুক তার দেশ। তার বাইরে অন্য কোনো কিছুতে জড়ানোর আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের নেই।
তাইওয়ানকে ঘিরে গত কয়েক বছর ধরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের উত্তরোত্তর অবনতি ঘটছে। আনুষ্ঠানিক কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রই তাইওয়ানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষক ও অস্ত্র সরবরাহকারী।
এক সময়ের স্বাধীন রাষ্ট্র তাইওয়ান আসলে পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ, যা তাইওয়ান প্রণালীর পূর্বদিকে চীনের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। প্রায় ৫ দশক ধরে এই দ্বীপ ভূখণ্ডকে নিজেদের বলে দাবি করে আসা চীন গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বার বার তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
১৯৪৯ সালে চীনের ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক সরকার ও কমিউনিস্টদের মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধে জয় হয়েছিল কমিউনিস্টদের। পরাজিত গণতান্ত্রিক সরকারের নেতারা তাইওয়ানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর থেকেই তাইওয়ানকে নিজেদের ভূখণ্ডের অংশ বলে দাবি করছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)।
তাইওয়ানের স্বাধীনতাপন্থী শক্তি অবশ্য বরাবরই চীনের এই দাবির তীব্র বিরোধিতা করে আসছে।
এদিকে, চীনের কবল থেকে তাইওয়ানকে রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে ‘কৌশলগত প্রচেষ্টা’ চালিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। এ কারণেই তাইওয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও ‘তাইওয়ান রিলেশন অ্যাক্ট’ নামে একটি চুক্তি অনুসারে দ্বীপটির কাছে অস্ত্র বিক্রিসহ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ বজায় রাখছে যুক্তরাষ্ট্র।
যে কারণে দুই কোরিয়া আছে এবং দুই ভিয়েতনাম ছিল, ঠিক দুই চীন থাকার কারণও সেটাই—স্নায়ুযুদ্ধ ও এর আগে-পরের ইতিহাস। দুই দেশই নিজেকে চীন মনে করে। এবং দুই দেশের মধ্যে দা-কুমড়ায় সম্পর্ক। কমিউনিস্টশাসিত চীনের কাছে তাইওয়ান হলো তাদের দলছুট অংশ। এই দলত্যাগী অংশ চীনের ক্ষমতার জন্য হুমকি।
বেইজিং ইতিমধ্যে বলপূর্বক তাইওয়ান প্রণালির দুই পারকে পুনরায় এক করার জন্য কাজ করছে। কিন্তু তাইওয়ান বলেছে, তারা নিজের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে।
চীনও ‘এই দেশ দুই নীতি’ নামে একটি ফরমুলা বের করেছে। এ নীতির আওতায় চীনের পুনরেকত্রীকরণ মেনে নিলে তাইওয়ানকে যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। তাইওয়ান এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, তবে চীনে ভ্রমণ ও বিনিয়োগের নিয়মনীতি শিথিল করেছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট পর্যায়ের বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তাইওয়ানের ওপর তার দেশের দাবি একটি ‘অলঙ্ঘনীয় রেড লাইন’। ২০২১ সালের শুরুর দিকে চীন ও তাইওয়ানের খারাপ সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে যায়। এ বছরের অক্টোবরে তাইওয়ানের আকাশসীমায় পরপর চার দিন সামরিক জেট পাঠিয়েছে চীন। খুব কম দেশই তাইওয়ানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি হয়ে গেছে চীনের বিরুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্বের যুদ্ধের ছায়া ময়দান।
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাইওয়ানের কাছে ফের পুরো দমে অস্ত্র বিক্রি শুরু করেছেন। এছাড়াও বাইডেন প্রশাসন স্বাধীনতা রক্ষায় দ্বীপটিকে সাহায্য করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে। বাইডেন এ বছরের অক্টোবরে বলেছেন, তাইওয়ানের ওপর চীন হামলা চালালে ওয়াশিংটন নাক গলাবে।
চীন হুমকি দিয়েছে, তাইওয়ান যদি স্বাধীনতালাভের চেষ্টা করে, তবে জোর খাটিয়ে হলেও দুই চীনকে এক করবে।
জাতিসংঘে পিআরসির রাষ্ট্রদূত ওয়াং ইংফ্যান বলেছেন, ‘তাইওয়ান প্রাচীনকাল থেকেই চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ তাইওয়ানিজ প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন বলেছেন, চীন আক্রমণ করলে নিজেকে রক্ষার জন্য তাইওয়ান ‘শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করবে’।
তাইওয়ান সতর্ক করে দিয়েছে, চীন যদি তাদের আকাশসীমায় বিমান পাঠায়, তাহলে তাইওয়ান গুলি চালাতে পারে। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী চিউ কু-চেং বলেছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে তাইওয়ানে হামলা চালাতে পারে চীন।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাইওয়ানকে পিপলস রিপাবলিক অভ চায়নার সঙ্গে যুক্ত করাকে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।
মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, তাইওয়ান দখলের ইচ্ছা থাকলেও চীন অন্তত বছর দশেকের মধ্যে দ্বীপটির ওপর হামলা চালাবে না বলে আশা করেন তিনি।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে তাইওয়ানের সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতি দুর্বল। এছাড়াও তাইওয়ানিজ সেনাবাহিনীর নৈতিক জোরও কম। তাছাড়া ‘তাইওয়ানের প্রাপ্তবয়স্ক লোকেরা বস্তুত লড়াই করতে চায় না’। আর চীনের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো শক্তি তাইওয়ানের নেই বলেই অনুমান করা হয় ওই প্রতিবেদনে।
চীনের কমিউনিস্ট নেতারা আসলেই তাইওয়ানে আক্রমণ চালাতে চান কি না, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে জোর বিতর্ক উঠেছে। আর চীনা নেতারা চাইলেও দেশটির সামরিক বাহিনী এই মুহূর্তে কিংবা নিকট-ভবিষ্যতে এমন হামলা চালানোর মতো শক্তিশালী কি না, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরাসরি বড় আকারের হামলা চালানোর জন্য চীন তার সামরিক বাহিনীর আকার বাড়াচ্ছে, এমন কোনো ‘লক্ষণ নেই’।
চীনের সামরিক কৌশল হলো বিদেশি সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে মার্কিন বাহিনীকে চীনা অঞ্চল থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখা। চীন এই কাজ করেছে খানিকটা দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি এবং ওইসব দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি তৈরির মাধ্যমে।
গেল কয়েক বছরে কৌশলের অংশ হিসেবে ওয়ারশিপ, অ্যান্টি-শিপ মিসাইলের সংখ্যা বাড়িয়েছে চীন। একে সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা কৌশল—কিংবা উপসাগর থেকে মার্কিন বাহিনীকে দূরে রাখার উপায়—হিসেবে দেখা যায়। এর ফলে দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথগুলোতে চীনের সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেইসঙ্গে তাইওয়ানকে বশে রাখার আকাঙ্ক্ষাও চরিতার্থ করেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৫
আপনার মতামত জানানঃ