৭৬ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে ১৩ নভেম্বর থেকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিএনপি ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে বার বার খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ নেয়ার অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন ও আহ্বান জানানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
তবে এবার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার আইনগত কোনো সুযোগ নেই বলে মতামত দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। আজ মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এ কথা জানান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আইন মন্ত্রণালয় থেকে খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসছে। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত পেয়েছি। আইন মন্ত্রণালয় আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে মতামত দিয়েছে। সেটা নিয়ে এখন আইনগত আরো কিছু বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে তাকে বিদেশে পাঠাতে আইনগত কোনো সুযোগ নেই। তাদের পর্যালোচনা শেষ হলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে।’
এর আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার বিষয়ে তার ভাইয়ের আবেদনে আইনি মতামত দেয়া হয়েছে। এখন সেটি যাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।’
তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন যে এর আগেও যতবারই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এটা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ফাইলটা গেছে। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ফাইলটা যাবে তাই আমার যে মতামত সেটা কিন্তু এখন আপনাদের বলতে পারব না। এটা গোপন রাখতে আমি বাধ্য।’
আসলেই কি সম্ভব নয়?
একাদশ জাতীয় সংসদের ১৫তম অধিবেশন শুরুর পর থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম জিয়াকে বিদেশে নেয়া ইস্যুতে বিতর্ক চলছে। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সংসদ অধিবেশন। বিএনপির এমপিরা বেগম জিয়াকে আইনিভাবে বিদেশে নেয়া যায়, এমন আইনি প্রক্রিয়া বাতলে দিচ্ছেন।
প্রয়োজনে মানবিক কারণে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দেয়ার জোড়ালো দাবি তুলে ধরছেন। আর আইনমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের একাধিক এমপি আইনের ৪০১ ধারা তুলে ধরে বেগম জিয়াকে বিদেশে নেয়া সম্ভব নয় মন্তব্য করছেন।
গত ১৮ নভেম্বর সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বিএনপির এমপি জিএম সিরাজ বলেন, খালেদা জিয়ার জামিন দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য আবেদন করা হয়েছে। জামিন দিয়ে তাকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক। প্রধানমন্ত্রী শপথ নিয়েছিলেন বিরাগের বশবর্তী হবেন না। সম্মান রেখেই বলছি ওনার বক্তব্যের সঙ্গে সেটার অসঙ্গতি দেখছি।
দেশে এর আগে সাজাপ্রাপ্ত আসামির উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেয়ার নজির রয়েছে। ১৯৭৯ সালে উন্নত চিকিৎসার জন্য সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দি আ স ম আবদুর রবকে জার্মানি পাঠানো হয়েছিল। ২০০৮ সালে প্রায় অভিন্ন অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমকে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। বিএনপির নেতারা অভিযোগ করে বলছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছিল।
আইনজীবীরা বলছেন, যে আইনের বলে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হয়েছে সেই আইনেই খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়া যায়৷ এটা সরকারের ইচ্ছার ব্যাপার।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় দণ্ড স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হয় গত ভছরে ২৫ মার্চ৷ শর্ত হলো তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না অথবা তাকে দেশেই থাকতে হবে৷
এই ধারা বলে কারো দণ্ড মওকুফও করতে পারে সরকার৷ আর খালেদা জিয়াকে বিদেশে না যাওয়ার শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হলেও ওই আইনেই শর্তহীনভাবেও মুক্তি দেয়ার বিধান আছে৷
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাহবুব হোসেন বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশে কারুর দণ্ড স্থগিত, পুরো বা আংশিক মওকুফ করে দিয়ে মুক্তি দিতে পারে৷ শর্ত সাপেক্ষে দিতে পারে আবার শর্তহীনভাবেও দিতে পারে৷ ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) যেহেতু দণ্ডিত তাই সরকার এই আইনেই তাকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে৷ তাকে দেশের বাইরে না যাওয়ার শর্ত তুলে শর্তহীন করার ক্ষমতা এই আইনেই সরকারকে দেয়া হয়েছে৷
তার মতে, এটা আবার শর্ত দিয়েও সরকার করতে পারে৷ শর্তে বলে দেয়া হবে যে, খালেদা জিয়া কত দিনের জন্য বিদেশে অবস্থান করতে পারবেন৷ আইনে কোনো বাধা নাই৷
তিনি বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি দেশের বাইরে যেতে পারবেনা এটা সাধারণ নিয়ম৷ খালেদা জিয়া তো আদালতের মাধ্যমে জামিনে মুক্তি পাননি৷ তিনি নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়েছেন৷ তার অভিযোগ, সরকার যা করেছে তা অনৈতিক এবং অমানবিক৷ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত৷
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, যারা এখন খালেদা জিয়ার বিষয় নিয়ে আদালতে যেতে বলছেন তারা আসলে ঠিক বলছেন না৷ কারণ এটা তো আদালতের সিদ্ধান্ত নয়৷ খালেদা জিয়াকে তো নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয়া হয়েছে৷ আর সেই আইনে শর্ত দেয়া বা না দেয়া সরকারের ইচ্ছা৷ এখন শর্ত তুলে নিলেই তো খালেদা জিয়া বিদেশ যেতে পারেন৷
কেন বিদেশে নেয়া প্রয়োজন?
লিভার সিরোসিসের চিকিৎসায় খালেদা জিয়ার ট্রান্সজুগুলার ইন্ট্রাহেপাটিক পোর্টোসিস্টেমিক সান্ট (টিআইপিএস) করানো প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তার চিকিৎসক।
গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসায় এক ব্রিফিংয়ে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা. ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশ বা সিঙ্গাপুর-ব্যাংককেও এর চিকিৎসা নেই।
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল রক্তক্ষরণে ভুগছেন বলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘ট্রান্সজুগুলার ইনট্রাহেপ্যাটিক পোর্টোসিস্টেমিক শান্ট (টিআইপিএস)’ চিকিৎসার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক।
খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে মিডিয়াকে ব্রিফ করার সময় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসক ডা. ফখরুদ্দীন মোহাম্মদ সিদ্দিকী বলেন, ‘এটি তার জন্য একমাত্র জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা। কিন্তু প্রযুক্তিটি ভারতীয় উপমহাদেশে, এমনকি ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরেও পাওয়া যায় না।’
টিআইপিএস হলো লিভারের মধ্যে একটি কৃত্রিম চ্যানেল, যা ইনফ্লো পোর্টাল শিরা এবং আউটফ্লো হেপাটিক শিরার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে।
তিনি আরও বলেন যে, খালেদার সাম্প্রতিক গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল রক্তক্ষরণগুলোর উৎস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করতে পারছেন না বলে ডাক্তাররা অসহায় বোধ করছেন।
খালেদা জিয়ার লিভার সিরোসিস হয়েছে জানিয়ে এই চিকিৎসক জোর দিয়ে বলেছেন যে, চিকিৎসার জন্য তাকে অবিলম্বে বিদেশে পাঠানো উচিত।
অধ্যাপক সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘ম্যাডাম এখন সিরোসিস অব লিভারে আক্রান্ত। হিমোগ্লোবিন লেভেল প্রথমবার কমে হয়েছিল ৫ দশমিক ৫। তারপর আমরা তাকে চার ব্যাগ রক্ত দিয়ে হিমোগ্লোবিন লেভেল ৯-১০ এর কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলাম। আবার সেটা কমে এসেছিল ৭ দশমিক ৮ এ। তারপর আবার রক্ত দিয়ে সেটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে তিনি চেস্ট টিউব নিয়ে ১৭ দিন কাটিয়েছেন। প্রতিদিন ওনার ফ্লুয়িড বের হয়ে এসেছে। প্রতিদিন উনি নিজের চোখে ব্লাড দেখেছেন। এন্ডলেস একটা সিচুয়েশন, সেখান থেকেও কিন্তু আমরা কনফিডেন্টলি বের হয়ে এসেছি।’
অধ্যাপক সিদ্দিকী বলেন, ‘মনোবল ওনার অনেক দৃঢ়। উনি আমাদের যথেষ্ট বিশ্বাস করেন। তবে আমাদের আর কিছু করার উপায় নেই। দ্যাট টাইম উই ওয়্যার কনফিডেন্ট, কিন্তু দিস টাইম আমরা হেল্পলেস ফিল করছি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য মিলিয়ে অন্তত ১৭ থেকে ২৩ জনের মেডিকেল টিম কাজ করছে।’
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ