বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য দেওয়া অনুদান কোথায় কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্র জানতে চাওয়ায় নতুন আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে বিশ্লেষকদের মধ্যে। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
মূলত র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর নানান আশঙ্কা কাজ করছে সরকারের মধ্যে। এই ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মন্ত্রীরা দাবি করলেও তা সবাইকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। অনেকের আশঙ্কা, সংশ্লিষ্ট আরও কারও কারও ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
সূত্র মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের পর থেকে দেশে আর ‘ক্রসফায়ার’-এর ঘটনা ঘটেনি। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, বড় ধাক্কার পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা একটু সমঝে চলছেন। তবে এতে গুমের আশঙ্কা বাড়ে বলে তারা মন্তব্য করেছেন।
সামরিক অনুদান ব্যয়ের তথ্য চায় যুক্তরাষ্ট্র
এদিকে র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগেই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য দেওয়া অনুদান কোথায় কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
মানবাধিকার সুরক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য এই অনুদান দেয় দেশটি। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও অনুদানের খরচের খতিয়ান চাওয়ার মধ্যে যোগসূত্র দেখছেন অনেকে।
সূত্র মতে, ১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র এক চিঠিতে জানায়, লিহেই আইনের নতুন সংশোধনী অনুযায়ী মার্কিন অনুদান অব্যাহত রাখতে চাইলে চুক্তি সই করতে হবে।
এ ছাড়া মানবাধিকার সুরক্ষার স্বার্থে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য দেওয়া অনুদান কোথায়, কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা-ও জানাতে হবে।
মার্কিন অনুদান পেতে বাংলাদেশ চুক্তি করবে কি না, সে বিষয়ে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছিল। যদিও ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর সামরিক অনুদান হিসেবে বাংলাদেশকে কোটি কোটি টাকা দিয়ে থাকে। কিন্তু এই অর্থ কোন বাহিনী পায় এবং কীভাবে ব্যয় হয়, সে সম্পর্কে তাদেরকে কোনও তথ্য দেওয়া হয় না।
এখন যুক্তরাষ্ট্র জানতে চাচ্ছে তাদের দেওয়া অনুদানের অর্থ কোন বাহিনী পাচ্ছে এবং তারা কীভাবে ব্যয় করছে। এ বিষয়ে একটি চুক্তি সইও করতে চায় মার্কিন সরকার। এজন্য বাংলাদেশ সরকারকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে ওই দেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি জোরদার করা একটি স্বাভাবিক ঘটনা।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার অধীনে সামগ্রিক সহযোগিতা রয়েছে এবং এটি তার একটি অংশ। আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামরিকসহ অন্যান্য সহযোগিতা ছিল, আছে এবং থাকবে।’
বাংলাদেশ কী সহযোগিতা পায়?
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬৪০ কোটি (প্রায় ৭.৫ কোটি ডলার) টাকা অনুদান পেয়েছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে রয়েছে ফরেন মিলিটারি ফাইন্যান্সিং এবং আন্তর্জাতিক মিলিটারি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ।
ওই ৬৪০ কোটি টাকার একটি বড় অংশ বঙ্গোপসাগরে মার্কিনিদের যে উদ্যোগ রয়েছে, সেটি শক্তিশালী করার জন্য বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ২০১৩ ও ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুটি ‘হ্যামিলটন কাটারস’ নৌজাহাজ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশগ্রহণ করে থাকে এবং বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য ৫০টি ‘মাল্টি রোল আর্মাড পারসোনেল ক্যারিয়ার’ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
২০০৫ থেকে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রায় ৩৮০ কোটি টাকা (সাড়ে চার কোটি ডলার) ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পাশাপাশি ২০১২ সালে ১৮ কোটি ডলার ব্যয়ে চারটি সি-১৩০ পরিবহন বিমান সংগ্রহ করেছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১১০ কোটি টাকা (১.৩ কোটি ডলার) মূল্যের ড্রোন দেবে বাংলাদেশকে এবং সেটি কারা ব্যবহার করবে, তা তারা জানতে চায়।
মার্কিন অনুদান র্যাব ব্যবহার করতে পারবে কিনা, জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র কোনও সংস্থাকে নিষেধাজ্ঞা দিলে তাদের দেওয়া অনুদানের অর্থ ওই সংস্থা ব্যবহার করতে পারবে না।’
নাম প্রকাশ না করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এর সঙ্গে র্যাবের কোনও সম্পর্ক নেই। কারণ এই তথ্য জানানোর জন্য তাদের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদি র্যাবের ওপরে নিষেধাজ্ঞা নাও থাকতো, তাহলেও এই চুক্তি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র উদ্যোগী হতো।’
হঠাৎ কেন এই নিষেধাজ্ঞা?
নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিক, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর দমন, নিপীড়ন ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের বর্তমান ও সাবেক ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়।
সেখানে র্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক মহাপরিচালক (বর্তমানে আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক তোফায়েল মুস্তাফা সারওয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খানের নাম রয়েছে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথক এক ঘোষণায় র্যাব-৭-এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর সে দেশে ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফে পৌর কাউন্সিলর একরামুল হককে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে সম্পৃক্ততার জন্য তার বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ৬৭টি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে র্যাবের সঙ্গে ২৫টি, পুলিশের ২৫টি, নৌ-পুলিশ একটি এবং বিজিবির ক্রসফায়ারে ১৬ জন নিহত হয়েছেন।
১ থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্রসফায়ারে ছয়জন মারা গেছেন। ৬ ডিসেম্বরের পর দেশে ক্রসফায়ারে কেউ মারা যায়নি। র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ সূত্র বলছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে র্যাবের সঙ্গে ১ হাজার ২৩টি বন্দুকযুদ্ধে ১ হাজার ৩১০ জন নিহত হয়েছেন। ক্রসফায়ারের ৯৮১টি ঘটনা তদন্ত করে ২৬ জন র্যাব সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর নিরাপত্তা বাহিনীর অন্য সদস্যসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় কি না, এমন আশঙ্কা রয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে।
যদিও এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তারা বলছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিলে আপাতদৃষ্টিতে খুব একটা ক্ষতি হবে না। তবে এমন ঘটনা ঘটলে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে।
একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য দেওয়া অনুদান কোথায়, কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে—হঠাৎ করে তা কেন জানতে চাইছে তারা। একই সময়ে র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে; এসবের মধ্যে যোগসূত্র আছে।
র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, তারা এখনো যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার সরকারি চিঠি পাননি। চিঠি পেলে স্বরাষ্ট্র বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তা নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে জবাব দেওয়া হবে।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, দুই সপ্তাহ বন্দুকযুদ্ধ কমেছে বলে খুশি হওয়ার কিছু নেই। কারণ, আগের পরিসংখ্যান বলছে, বন্দুকযুদ্ধের সংখ্যা কমলে গুমের সংখ্যা বেড়ে যায়। আবার গুমের সংখ্যা কমলে বন্দুকযুদ্ধ বেড়ে যায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৪৫
আপনার মতামত জানানঃ