ভিক্টিম ব্লেমিং বাংলাদেশে এক সামাজিক প্রথায় পরিণত হয়েছে। ঘটনার পেছনে অপরাধীর ভূমিকা বিশ্লেষণ না করে ভুক্তভোগীর ভূমিকা খোঁজার চেষ্টা করা হয়। ভুক্তভোগী যদি নারী হয় তবে অপরাধীর অপরাধ বিবেচনার চেয়ে উক্ত ঘটনার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত নারীর ঘাড়ে সামান্যতম হলেও দায় চাপানোর প্রবণতাই বেশি লক্ষ্য করা যায়। ভুক্তভোগীর প্রতি দোষ চাপানোর এই বিষয়টিকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’।
ইভটিজিং, শ্লীলতাহানি, ধ’র্ষণ কিংবা প্রেম, পরকীয়াজনিত ভুক্তভোগীরা সবচেয়ে বেশি ব্লেমিং-এর শিকার হয়। সম্প্রতি চলচ্চিত্রের নায়িকা পরীমণি থেকে শুরু করে আলোচিত কলেজছাত্রী মুুনিয়া, ফেনীর নুসরাত জাহান, কুমিল্লার তনু ভিক্টিম ব্লেমিং-এর আলোচিত নাম। সমাজের বিশাল একটা অংশ আলোচনা করেছে অপরাধীর তুলনায় এদের দোষ নিয়ে। পিছিয়ে নেই পুলিশও।
ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের কিছু সাধারণ উদাহরণ হলো, কোনো মেয়ে ধ’র্ষণ বা শ্লীলতাহানির শিকার হলে অধিকাংশ মানুষ বলে থাকে, এটা মেয়েটার দোষেই হয়েছে। তার পোশাক, চালচলন বা কোনো কার্যকলাপের ফলেই অপরাধী প্রলুব্ধ হয়েছে। কিংবা দুর্ঘটনাটি ঘটার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নারীর খোলামেলা পোশাক ধ’র্ষণ করাকে উস্কে দেয়।
ধ’র্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় নারীদের রাতে একা বাইরে যাওয়া উচিত না। নারীরা রাতে বাইরে গিয়ে ধ’র্ষণকে উৎসাহিত করে। আবার কোনো নারী যদি মাতাল বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ধ’র্ষণের শিকার হয় তখন বলা হয় এটি তার নিজস্ব দোষের কারণে ঘটেছে। নারীদের উচিত নিজেকে সুরক্ষিত রাখা।
এমনও বলা হয় ‘কই, আমাদের সাথে তো এমন কিছু ঘটে না! তার সাথে কেন ঘটলো?’ এমনি করে সাইবার বুলিং এর ক্ষেত্রেও মেয়েদের দোষারোপ করা হয়। এ যেন এক নতুন সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে নারী পর্যটককে দলবদ্ধ ধ’র্ষণের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান বেশ দৃষ্টিকটু। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। যদিও জড়িতদের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। র্যাব বলছে, তারা দুজনকে শনাক্ত করেছে। তবে এখনো তাদের গ্রেপ্তার করা যায়নি।
তবে আসামিদের ধরার আগেই নির্যাতিত নারীকে দুষতে শুরু করেছে পুলিশ। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় গতকাল বিকেলে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ‘কক্সবাজার জেলায় আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সেবার মানোন্নয়ন বিষয়ে’ জরুরি সভা হয়।
সেই সভা শেষে টুরিস্ট পুলিশের এসপি মো. জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, প্রধান আসামি আশিকুল ইসলাম ও ভুক্তভোগী নারীর পূর্ব পরিচিত। ঘটনার দিন কোনো কারণে তাদের মধ্যে সমস্যা হয়। সেই ঘটনার জের ধরেই ওই নারীকে তুলে নেওয়া হয়।
ভুক্তভোগী নারী, তার স্বামী ও সন্তান বর্তমানে টুরিস্ট পুলিশের হেফাজতে আছেন। গতকাল বিকেলে দীর্ঘ সময় ধরে ওই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিকেল পাঁচটার দিকে তাকে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-৩ আদালতে আনা হয়। সেখানে তিনি জবানবন্দি দেন। তবে জবানবন্দিতে তিনি কি বলেছেন জানা যায়নি।
পুলিশ দাবি করে, ঢাকার যাত্রাবাড়ীর জুরাইন এলাকায় থাকার কথা বললেও ওই দম্পতি তাদের সন্তানসহ তিন মাস ধরে কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলে থাকছিলেন। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নাম ব্যবহার করতেন। ওই নারী পুলিশের কাছে বিষয়টি স্বীকার করেছেন বলেও দাবি করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
গত বুধবার দিবাগত রাতে কক্সবাজার শহরের লাবণি পয়েন্ট থেকে তুলে নিয়ে দুই দফায় দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয় ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে বেড়াতে যাওয়া পর্যটককে। এ ঘটনায় দুজনকে শনাক্ত করার কথা জানিয়েছে র্যাব।
এর মধ্যে একজন শহরের বাহারছড়া এলাকার আবদুল করিমের ছেলে আরিফুল ইসলাম আশিক, অপরজন তার সহযোগী ইস্রাফিল হুদা জয়। আশিক ও জয়সহ সাতজনকে আসামি করে বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী নারীর স্বামী।
শহরের বাহারছড়া এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, কক্সবাজারে সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের মূল হোতা আশিক। তার নেতৃত্বে রয়েছে ৩২ জনের একটি অপরাধী চক্র। সবাই তাদের চেনে। আশিক বড় ধরনের অপরাধী।
তারা একেকজন একেকভাবে বিভক্ত হয়ে আবার কখনো দুই-তিনজন দলভুক্ত হয়ে শহরের অলিগলিতে চুরি, বিচে ছিনতাই ও খুনসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড করে বেড়ায়। পর্যটকদের তেমন কোনো নিরাপত্তা নেই। তবে অভিযোগ পেলে ট্যুরিস্ট পুলিশ আসে।
পুলিশ ও র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, আরিফুল ইসলাম আশিক ও তার সহযোগী আবদুর রহমান জয় ছিনতাইকারী। আশিকের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা রয়েছে। তার সহযোগীর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা আছে। একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন দুজন।
ধর্ষণের শিকার নারীর ভাষ্য অনুযায়ী, প্রথমে সৈকতের লাবণী পয়েন্টের সানি বিচ এলাকার ঝুপড়ি ঘরে তাকে ধর্ষণ করে তিন যুবক। পরে সেখান থেকে নিয়ে জিয়া গেস্ট ইনে আরেক দফায় তিনজন তাকে ধর্ষণ করেন। পরে র্যাব তাকে উদ্ধার করে।
গতকাল জরুরি সভা শেষে টুরিস্ট পুলিশের এসপি জিল্লুর রহমান বলেন, আসামি আশিকুল ইসলাম, মেহেদী হাসান ওরফে বাবু ভুক্তভোগী নারীর পূর্ব পরিচিত। তাকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে যখন আশিক নিয়ে যান তখন মূল সড়ক দিয়েই গেছেন।
এরপর জিয়া গেস্ট রুমে যখন যাচ্ছিলেন, তখন সড়কে অনেক লোকজন ছিল। কিন্তু ওই নারী কোনো ধরনের চিৎকার-চেঁচামেচি করেননি। আমরা চাই প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হোক। এ রকম ঘটনা যাতে পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেদিকে তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।
ওই নারী অভিযোগ করেছেন তাকে তুলে নেওয়ার সময় তার স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে আটকে রেখেছিল সন্ত্রাসীরা। এ বিষয়ে জিল্লুর রহমান বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, ভুক্তভোগীর স্বামীর কাছে আশিক চাঁদা চেয়েছিল। চাঁদা দেয়নি বিধায় তাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হবে, এমন হুমকি দেওয়া হয়। সেই হুমকি পাওয়ার পর ওই নারীর স্বামী আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সহযোগিতা চান।
স্থানীয় বাসিন্দা আবুল মঞ্জুর বলেন, সন্ধ্যা হলেই লাবণী বিচ থেকে শুরু করে কবিতা চত্বর ও ডায়াবেটিক পয়েন্ট এবং ঝাউবাগানের আশপাশে কোনো নিরাপত্তা থাকে না। বলতে গেলে অপরাধীদের দখলে থাকে এসব এলাকা। ফলে এসব এলাকায় প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়। এসব এলাকায় জেলা পুলিশ ও ট্যুরিস্ট পুলিশের কোনো তৎপরতা নেই। এখানে পুলিশ নিষ্ক্রিয়। জেনেও ব্যবস্থা নেয় না তারা।
এ প্রসঙ্গে ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের অতিরিক্ত সুপার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন ঝাউবাগানের শৈবাল ও কবিতা চত্বরে পুলিশ বক্স রয়েছে। সেখানে অপরাধীদের বিচরণ কিংবা আড্ডা দেওয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে ওই নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পর্যটক। শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও। তারা বলছেন, দেশের প্রধান পর্যটনস্থল বিশ্বের দীর্ঘতম এই সৈকত। এখনে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হলে পর্যটক আসা কমে যাবে। এতে দেশের পুরো পর্যটন খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩০
আপনার মতামত জানানঃ