রাত দু’টার দিকে আগুন ধরে যায় লঞ্চটিতে। এ সময় আর্তনাদ, হৈ-চৈ আর চিৎকারে অবর্ণনীয় এক পরিবেশ তৈরি হয়। আগুন থেকে প্রাণ বাঁচাতে নারী, পুরুষ ও শিশুরা নদীতে ঝাঁপ দিতে থাকেন, যাদের অনেকে এখনো নিখোঁজ আছেন। এক পর্যায়ে ঝালকাঠির দিয়াকূল গ্রামে তীরে লঞ্চটি ভেড়ানো হলেও দ্রুত নামতে গিয়ে আটকে পড়া যাত্রীদের অনেকে আহত হন। কেউ কেউ শিশু সন্তান হারিয়ে এখনো খুঁজে পাননি।
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনার অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লেগে লেগে ৪০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। এ ঘটনায় নিহতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৩৭টি লাশ বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর ভিতরে ৫টি লাশ শনাক্ত করা হয়েছে। চারটি তাদের স্বজনদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বরগুনার অভিযান-১০ লঞ্চটি গত বৃহস্পতিবার (সন্ধ্যা ৬ টায় ঢাকা থেকে বরগুনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। রাত সাড়ে ৩টায় ঝালকাঠি পৌঁছলে সুগন্ধা নদীতে লঞ্চটিতে আগুন লেগে যায়।
ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর থেকেই ইঞ্জিনের দিক থেকে মাঝে মধ্যেই জোরে শব্দ হচ্ছিলো আর প্রচণ্ড কালো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিলো। আমরা অনেকেই বুঝতে পারছিলাম যে কোনো একটা ঝামেলা হচ্ছে। লঞ্চের ফ্লোরগুলোও গরম হয়ে উঠছিলো। স্টাফরা বলছিলো সমস্যা হবে না।
এরপর হঠাৎই প্রচণ্ড শব্দ শোনা যায় এবং রাত দু’টার পর থেকে রাত তিনটার মধ্যে সম্পূর্ণ লঞ্চটিতে আগুন ধরে যায়। এক পর্যায়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলেও গতির কারণে লঞ্চটি রানিং ছিলো বেশ কিছুটা সময়। এ সময়ে বাতাসে আগুন আরও ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া যাত্রীবাহী সব লঞ্চের মতো এটিতেও যাত্রীদের প্রচুর পরিমাণ কাপড় আর ভেতরে ফ্লোরে কার্পেটের মতো থাকায় দ্রুতই আগুন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
এক সাংবাদিকের ভাষ্যমতে
লঞ্চের আগুন লাগার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন প্রাণে বেঁচে ফেরা এক যাত্রী সাংবাদিক সানাউল্লাহ। সাংবাদিক সানাউল্লাহ বলেন, ঢাকা থেকে বরগুনার উদ্দেশ্যে আমি এই লঞ্চটিতে যাচ্ছিলাম। লঞ্চটি ছাড়ার পর চালকের মধ্য থেকে একজনকে বলতে শুনেছি, স্যার ইঞ্চিন ৪০০ তে, স্পিড ১১.৯-১২। তখন কিছু বুঝিনি।
তিনি বলেন, এর পর ঘুমিয়ে পড়ি। রাত ৩ টা ০৮ মিনিটে মানুষের চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠে দেখি পিছনের দিকে আগুন আর আগুন। কি করব ভেবে পাচ্ছি না। শত শত মহিলারা শিশু বাচ্চাদের কোলে নিয়া ছোটাছুটি করতেছে। তখন সিঁড়িতে আগুন জ্বলতেছে। আমিও হতাশ হয়ে ছোটাছুটি শুরু করি।
স্ত্রীকে ফোন দিয়ে জানাই এবং সবাইকে জানাতে বলি, আর বিদায় নেই। তখনই মাথাটা একটু খাঁটিয়ে নিলাম। এই সময় হতাশ হলে চলবে না। সব গুছিয়ে নিলাম। সামনের দিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। মানুষের কান্না, আহাজারি, দেখে নিজেকে আর স্থির রাখতে পরিনি। নামব কীভাবে সে প্লান খুঁজছি।
তিনি আরও বলেন, আগুন লাগার কিছুক্ষণ পরই ৩টা ১৩-১৫ মিনিটে লঞ্চটিকে চরভাটারাকান্দা নামক এলাকায় ভিড়ানো হয়। কিন্তু পাড়ে মাটি না থাকায় লঞ্চ ধাক্কা খেয়ে পিছনে চলে যায়। তখন অনেকে বলছে- ভিড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রশিটা দিয়েন।
কিন্তু মানুষ তো জাতে বাঙালি। রশির ওপরে সব। রশি আর দেওয়া সম্ভব হয়নি। তখন রশিটা দিতে পারলে হয়ত এতটা প্রাণহানি ঘটত না। কিছু মানুষ তখন লাফ দিয়ে নামতে সক্ষম হয়।
সাংবাদিক সানাউল্লাহ বলেন, বুদ্ধি করে নামাজের স্থানে টানানো রশিটা নিলাম। মোটা করে সাজিয়ে মধ্যে গিট্টু দিয়ে রেলিং বেধে তৈরি হলাম। এর মধ্যে নিচতলা থেকে অনেকের চিৎকার শুনতে পাই। লঞ্চ তখন নদীর মাঝখানে। তখন রাত্র ৩টা ৩০ মিনিট ওভার।
এরই মধ্যে বাম দিকে তাকিয়ে দেখি কিনারা দেখা যায়। অর্থাৎ দিয়াকুল। রশি নিয়ে তৈরি। ঠিক ৩ টা ৩৫ সময় একদম লঞ্চটি কিনারে। তখনও বলা হয় রশি দিতে। এখন আর সময় করা ঠিক হবে না। কারণ গ্যাসের কারণে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। লঞ্চ পুনরায় ছুটে যেতে নিছে। পায়ের নিচটা গরম হয়ে আসছে। রশিটা ধরে একদম নিচতলায়। যতটা পারছি কয়েকজনকে সাহায্য করেছি। এর পর নদীর কিনারায় ঝাঁপ দেই।
তিনি বলেন, কিনারায় আসার পর জানতে পারলাম আগুন লাগার কারণ। লঞ্চটিতে নতুন একটা ইঞ্জিন লাগানো হয়েছে। কিন্তু ইঞ্জিনে সমস্যা ছিল। গ্যাস জমে। বুধবার ঢাকার ঘাটে ৪ জন ইঞ্জিনিয়ার এসে সেরেছে। তারা যখন বলছে ইঞ্জিন ওকে, তখন ট্রিপের প্রস্তুতি নেয়া হয়। কিন্তু লঞ্চে একজন ইঞ্জিনিয়ার থেকে যায় দেখার জন্য এবং মালিকও লঞ্চে ছিলেন। ইঞ্জিন চলতি অবস্থায় বহুবার অস্বাভাবিক শব্দ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। এরপরই দুর্ঘটনা ঘটে।
আইনজীবী দম্পতির ভাষ্যমতে
লঞ্চের আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া এক আইনজীবী দম্পতি ঘটনার বর্ণনা দেন। তারা হলেন বরগুনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমডি আনিসুর রহমান ও তার সহধর্মিণী।
এমডি আনিসুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত অনুমান ৩টার দিকে লঞ্চে আগুন লাগে। ইঞ্জিনরুম থেকে আগুন দ্রুত পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আগুনের লেলিহান শিখা ও ধোঁয়ায় পুরো লঞ্চ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এ সময় লঞ্চের ডেকে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। প্রাণ বাঁচাতে অনেকে নদীতে ঝাঁপ দেয়।
আমরা যারা কেবিনে ঘুমিয়ে ছিলাম, তারা চিৎকার শুনে বের হয়ে চারদিকে ছোটাছুটি করতে থাকি। ধাক্কাধাক্কি ও পদদলিত হয়ে অনেকে আহত হয়। পুরো লঞ্চের যাত্রীরা ডাক-চিৎকার আর আর্তনাদ করতে থাকে। যে যেভাবে পেরেছে নিজের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। অনেকে স্বজনদের রেখেই ঝাঁপ দিয়েছে নদীতে।
তিনি বলেন, আমরা অনেকেই বেঁচে থাকার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। সন্তান সাঁতার জানে না। নাড়িছেঁড়া ধন রেখে নদীতে ঝাঁপ দেবেন কীভাবে মা-বাবা। আবার অনেক স্বামী-স্ত্রীরাও এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিলেন। শেষমেশ বিধাতার ওপর ভরসা রেখে অনেকেই ঝাঁপ দেন নদীতে।
আমরা দোতলায় একটি ডবল কেবিনে ছিলাম। আগুন ধেয়ে আসছে আমাদের দিক। মনে করেছি আর বাঁচবো না। আমরা দুজন দোতলা থেকে নিচে নেমে লঞ্চের সামনে একটি বস্তার উপর দাড়াই। আস্তে আস্তে লোহা গরম হতে থাকে।
তিনি বলেন, আমাদের ব্যাগ কেবিনে রেখে স্ত্রীর ভ্যানিটি ব্যাগটি নিয়ে দাড়িয়ে থাকি। দ্রুত আমাদের কাছে অনেক লোক জড়ো হয়। লঞ্চের পিছনে দোতলা ও তৃতীয় তলায় তখন আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে।
আমি প্রথমে আমার বড় ছেলে ব্যাংক কর্মকর্তা রাসেলকে ফোন দেই। তার ফোন বন্ধ পাই। পরে ছোট ছেলেকে ফোন দিয়ে বলি বাবা আমরা বিপদে পরেছি। তোদের সাথে আর আমাদের দেখা নাও হতে পারে। লঞ্চে আগুন লেগেছে।
ওই আইনজীবী বলেন, আস্তে আস্তে লঞ্চটি কিনারে ভিরে। আমরা নিরাপদে কিনারে উঠলেও অনেক যাত্রী নদীতে ঝাপ দিয়ে পরে। অনেক যাত্রী নদীতে পরে উল্টো দিক সাতার দেয়।
আমি কিনারে উঠে বরিশালের পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেনকে ফোনে জানাই। তিনি বরগুনায় পুলিশ সুপার ছিলেন। তিনি ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়েছেন। আমরা যারা বেঁচে আছি ওই রাতে ওখানকার ইউপি চেয়ারম্যান আমাদের একটি স্কুল ঘরে আশ্রয় দেয়। ভোর রাতে একটি ট্রলারে আমরা ঝালকাঠি হয়ে বরগুনা আসি।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৪৫
আপনার মতামত জানানঃ