টাইমস স্কয়ারে হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে নিউইয়র্কে গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুবক আশিকুল আলম আদালতে দায় স্বীকার করেছেন। নিজে থেকেই অপরাধ স্বীকার করায় বিচারিক সমঝোতা অনুযায়ী আশিকুলকে পাঁচ বছরের দণ্ড ভোগ করতে হবে। দণ্ড ভোগ শেষে তাকে আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার ব্রুকলিনের ফেডারেল আদালতে ইউএস ম্যাজিস্ট্রেট রবার্ট এম লেভির আদালতে আশিকুল জ্ঞাতসারে সিরিয়াল নম্বরহীন আগ্নেয়াস্ত্র নিজের মালিকানায় নিয়ে আসার অপরাধ স্বীকার করেছেন। একই আদালতে তাকে আমেরিকা থেকে বিতাড়নের নির্দেশ দিলে সেই শাস্তিও মেনে নেন আশিকুল আলম।
মামলার রায় ঘোষণার পর ইউএস অ্যাটর্নি ব্রিয়ন পিস বলেন, আমেরিকার লোকজনকে দেশে ও দেশের বাইরে নিরাপত্তার মধ্যে রাখা তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। সন্ত্রাসী অভিযোগে অভিযুক্ত আশিকুল আলম স্বেচ্ছায় অপরাধ স্বীকার করেছেন বলে ব্রিয়ন পিস তার বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন।
আশিকুলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ
টাইমস স্কয়ারে হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে ২০১৯ সালের জুন মাসে আশিকুল আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। গ্রেপ্তারের পর আদালতে তার বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অবৈধভাবে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অভিযোগ আনা হয়।
গ্রেপ্তারের পর প্রসিকিউশন থেকে দাবি করা হয়, বেশ কিছুদিন ধরেই আশিকুলকে নজরদারিতে রাখা হয়েছিল। ২২ বছর বয়সী আশিকুল তখন বাংলাদেশিবহুল জ্যাকসন হাইটসেই বসবাস করতেন। অভিবাসন সূত্র অনুসারে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ডধারী।
২০১৯ সালের ৬ জুন গ্রেপ্তারের এক দিন পর ব্রুকলিনের ইউএস ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে আশিকুলকে হাজির করা হয়। আইনজীবী জেমস ডারো তার মক্কেলকে দুই লাখ ডলার মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার আবেদন জানান।
অনুরোধ করেন, কারাগারে না রেখে তাকে গৃহবন্দী করে পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য। ডারো আরও জানান, আশিকুল তার মা-বাবার সঙ্গেই থাকেন এবং তারা বন্ডে স্বাক্ষর করার জন্য প্রস্তুত আছেন। তবে আদালতে সংক্ষিপ্ত শুনানির পর বিচারপতি চেরিল পোলাক আশিকুলকে জামিন না দিয়ে আটক রাখার নির্দেশ দেন।
ব্রুকলিনের ফেডারেল আদালতে দায়েরকৃত অভিযোগ থেকে জানা যায়, আশিকুলের কাছ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া দুটি গ্লক ১৯ আধা স্বয়ংক্রিয় পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। এর পরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নাইন ইলেভেন হামলাকে সমর্থন
এক কর্মকর্তা জানান, আশিকুলকে কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছিল। একজন গোয়েন্দা ছদ্মবেশে তাকে অনুসরণ করছিলেন। ওই গোয়েন্দার সঙ্গে আশিকুলের কথাও হয়েছে। দুজনের সাক্ষাতে তিনি নাইন ইলেভেন হামলাকে সমর্থন করেন বলে জানিয়েছিলেন। হামলায় সুইসাইড ভেস্ট ও হাতবোমার ব্যবহার নিয়েও আলোচনা করেছিলেন তিনি।
নথিতে বলা হচ্ছে, ২০১৮ সালের ১১ই সেপটেম্বর যখন ওই সরকারি গোয়েন্দার সাথে আলমের দেখা হয়, তখন তিনি নাইন ইলেভেনের হামলার জন্যে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের বিষয়ে আলাপ করেছিলেন।
তিনি বলেছেন, ‘মিশনটা পুরোপুরি সফল, হাজার হাজার আমেরিকান সেনা মারা গিয়েছিল, যুদ্ধের জন্য ট্রিলিয়ন ট্রিলয়ন অর্থ ব্যয় হয়েছিল।’
‘আপনি জানেন, খলিফা তৈরি করা মুসলিমদের দায়িত্ব,’ তখন বলেছিলেন আলম। তদন্ত কর্মকর্তারা এমনটা দাবী করছেন। তিন দিন পর তিনি আবার দেখা করেন সরকারি ওই গোয়েন্দার সাথে।
তখন ওই এজেন্ট তার কাছে জানতে চান বিন লাদেনের স্থলাভিষিক্ত কে হতে পারেন, আলমের উত্তর ছিল, ‘তিনি (বিন লাদেন) তার কাজ করেছেন। তার যেটা করা উচিত ছিল, তিনি সেটা করেছেন। এখন বাকিটা আমাদের উপর।’
টাইমস স্কয়ারে হামলার পরিকল্পনা
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি রিচার্ড ডোনোঘুয়ে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘অভিযোগ অনুযায়ী আশিকুল আলম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের হত্যা ও টাইমস স্কয়ারে বেসামরিকদের ওপর হামলা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অবৈধ অস্ত্র কিনেছিলেন।’
তিনি টাইমস স্কয়ার কিংবা এক মার্কিন সরকারি কর্মকর্তাকে হত্যার জন্য ওয়াশিংটনে হামলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
দায়েরকৃত অভিযোগ থেকে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালের এপ্রিলে পেনসিলভানিয়ায় ছদ্মবেশী ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল আশিকুলের।
তিনি জানিয়েছিলেন, হামলার আগে চোখে লেজার চিকিৎসা করাবেন; যেন সে সময় চশমা পরতে না হয়। মিডিয়া যেন তাকে ‘অন্ধ সন্ত্রাসী’ নাম না দিতে পারে।
কে এই আশিকুল আলম?
আশিকুল আলমের বাড়ি বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায়। অর্ধযুগেরও কিছু আগে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়া আলম সেখানকার জন জে কলেজ অফ ক্রিমিনাল জাস্টিস-এর তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছিলেন।
তার বাবা মোঃ শাহজাহান ম্যানহাটনের একটি ফুড কোর্টের ব্যবসায়ী বলে জানা যাচ্ছে। কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসে যে বাংলাদেশি কমিউনিটি রয়েছে, সেখানকার লোকজনের সাথে তেমন ভালো মেলা-মেশা ছিল না আলমের।
খুন্ন হচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি
যখন আশিকুল আলম আটক হন, তখন এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক, তারেক শামসুর রেহমান বলেছিলেন, ‘এসব ঘটনার কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বে একটি খারাপ ধারণা তৈরী হচ্ছে। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী গোষ্ঠী বাংলাদেশের উপর নজরদারী বাড়িয়েছে। এসব ঘটনার কারণে তাদের আরো এসব বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
কেন এমন ঘটনা বাড়ছে? এমন প্রশ্নে তিনি জানান, ‘ যারা এসবের সঙ্গে জড়াচ্ছে তারা বিভ্রান্তিতে পড়ে এসব করছে। এর জন্য আরো সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে যারা সিনিয়র সিটিজেন আছে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানেরা কোথায় যায়,কার সঙ্গে মিশে এসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।’
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত বিশিষ্ট কূটনৈতিক ব্যাক্তিত্ব হুমায়ূন কবির বলেছিলেন, এসব ঘটনা কোন ভাবেই ইতিবাচক নয়। এর মাধ্যমে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তবে এর জন্য যেটা বেশি দরকার সেটা হলো সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ধরনের ফাঁদে যেন কেউ পা না দেয় সেদিকে খেয়াল রাখাটা বেশি জরুরী।
এর কারণে কেমন প্রভাব পড়বে বাংলাদেশি কমিনিউটির উপর-এ বিষয়ে তিনি জানান, আমি মনে করছি, এটা ব্যাক্তিগত একটা বিষয়, এজন্য এ ঘটনার জন্যই ওই যুবকই দায়ী। আমাদের বাংলাদেশী বংশোদ্রুত অনেকে ভালো অবস্থায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। পুলিশ বিভাগেও রয়েছে অনেকে। তাই ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়তো কিছুটা হবে। কিন্তু বেশি যে বিষয়টি দরকার সেটি হলো সচেতনতা বাড়ানো।
বিভিন্ন তথ্য থেকে দেখা যায়, কিছু পশ্চিমা দেশে অবস্থানকালেই বাংলাদেশি অধিকাংশ যুবক জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। বাংলাদেশে থাকাকালে যাদের কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই। অর্থাৎ জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং উগ্রতার বিস্তার রোধে উন্নত রাষ্ট্রগুলোরও ব্যর্থতা রয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ