সর্বাধিক কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তালিকায় থাকা চীন প্রতিবছরই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যায় আক্রান্ত হয়। অনেক রাজ্যেই বন্যার কারণে প্রতিবছরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এবার চীনে বন্যা ঠেকাতে ‘স্পঞ্জ সিটি’ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। স্পঞ্জ সিটি হলো এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে শহরগুলো বৃষ্টির জল শুষে নিয়ে বন্যা প্রতিরোধ করবে। খবর বিবিসি, দি ইকোনোমিস্ট
চীনের লেশান শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইয়াংসি নদীর তিন-তিনটি শাখা। কয়েক শতাব্দী আগে লেশান শহরের বাসিন্দারা পাহাড় খোদাই করে বুদ্ধের একটি পাথরের মূর্তি তৈরি করেছিলেন। লেশান শহরের বাসিন্দারা বলে থাকেন, ‘বুদ্ধের পা যখন পানিতে তলিয়ে যায়, লেশান তখন ঘুমাতে পারে না’।
৭০ মিটার উচ্চতার এই প্রাচীন বুদ্ধমূর্তিটি নদীর পাশে থাকলেও এত দিন কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু ২০২০ সালের অগস্ট মাসে বিশাল আকৃতির বুদ্ধমূর্তিটির পা জলের তলায় তলিয়ে যায়। গত বছর লেশান শহরটি ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। বন্যায় লেশানের বাসিন্দারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
লেশানে এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে শুধু নদীই দায়ী নয়, শহরটি যেভাবে গড়ে উঠেছে, তারও দায় রয়েছে।
নগর-পরিকল্পনাবিদেরা শহরটি থেকে বন্যার পানিনিষ্কাশনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
চার দশকের অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে চীনের অন্য অনেক শহরও একই সমস্যার মুখোমুখি। অতিবৃষ্টির ফলে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে শহরগুলোর প্রস্তুতি খুবই দুর্বল।
গত জুলাইয়ে দেশটির মধ্যাঞ্চলীয় হেনান প্রদেশের রাজধানী ঝেংঝুতে ঝড় আঘাত হানে। সেখানে এক বছরের সমান বৃষ্টিপাত হয় মাত্র তিন দিনে। অতিবৃষ্টি থেকে সৃষ্ট বন্যার পানিতে গাড়ি পর্যন্ত ভেসে যায়। এই ঘটনায় প্রায় ৩০০ জন প্রাণ হারান।
চীনা গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে বন্যায় বার্ষিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে।
১৯৫০ সালে চীনে প্রতি ১০ জনে একজন শহরে বাস করত। এখন এই সংখ্যা প্রতি ১০ জনে ছয়জন দাঁড়িয়েছে। প্রায় ৭০ শতাংশ শহর প্লাবনভূমিতে অবস্থিত।
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থপতি ইউ কংজিয়ান বলেন, ‘আমরা অতিরিক্ত নির্মাণযজ্ঞ চালিয়েছি। আমরা ভুলভাবে এটা করেছি।’
চীনে বন্যা ঠেকাতে ‘স্পঞ্জ সিটি’ গড়ে তোলার জন্য যেসব ব্যক্তি প্রথম আহ্বান জানান, তাদের একজন কংজিয়ান। স্পঞ্জ সিটি হলো এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে শহরগুলো বৃষ্টির পানি শুষে নিয়ে বন্যা প্রতিরোধ করবে। কংজিয়ান চীনের পুরোনো সেচব্যবস্থা থেকে এই কৌশল তৈরির প্রেরণা পান।
যেদিন নদীতে ডুবে মরতে বসেছিলেন সেদিকের কথা স্পষ্ট মনে আছে ইউ কংজিয়ানের। তার বাড়ির পাশের একটি নদীতে বন্যার পানি ঢুকছিল। ১০ বছর বসয়ী ইউ কংজিয়ান কৈশোরের অদম্য কৌতুহলে গিয়েছিলেন বন্যার পানি আসা দেখতে।
হঠাৎ ভূমিধসের কারণে তিনি নদীতে পড়ে যান। নদীর পাশের গাছপালা ধরে প্রবল স্রোতে ভেসে যাওয়া থেকে রক্ষা পান তিনি।
বিবিসিকে তিনি বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই নদীর পাড় এখনকার মতো কংক্রিট নিয়ে বাঁধানো হলে আমি প্রাণ বাঁচানোর জন্য কোনো কিছু খুঁজে পেতাম না।
সেদিনের সেই ঘটনা শুধু ইউ কংজিয়ানের জীবনকেই বদলে দেয়নি, বদলে দিয়েছে চীনের বহু জায়গা।
ইউ কংজিয়ান চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত নগর পরিকল্পনাবিদদের একজন। কংজিয়ান পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার অ্যান্ড ল্যান্ডস্কেপ কলেজের ডিন ও ‘স্পঞ্জ সিটি’ ধারণার জনক।
স্পঞ্জ সিটি হলো এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে শহরগুলো বৃষ্টির জল শুষে নিয়ে বন্যা প্রতিরোধ করবে।
এই ধারণাকে প্রয়োগ করেই চীনের বহু শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বন্যার অতিরিক্ত পানি শহরগুলোতে নানা উপায়ে ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি মনে করেন, বিশ্বের অন্যান্য শহরেও এই ‘স্পঞ্জ সিটি’ গড়ে তোলা সম্ভব। যদিও প্রবল বন্যার সময় এই পরিকল্পনা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বন্যাকে ভয় না করে কেন তাকে বরণ করা যায় না—অধ্যাপক ইউয়ের ‘স্পঞ্জ সিটি’ ধারণার মূল প্রশ্নই এটি।
বর্তমানে বন্যা নিয়ন্ত্রণে দৃষ্টি দেওয়া হয় পাইপ বসিয়ে, ড্রেন তৈরি করে বন্যার পানিকে যত দ্রুত সম্ভব পার করে দেওয়া। অথবা নদীর দুই কূল কংক্রিট দিয়ে বাধাই করা যেন বন্যার পানি উপচে না পড়ে।
কিন্তু স্পঞ্জ সিটিতে এর উল্টো কাজ করা হয়। এখানে বন্যার পানিকে স্পঞ্জের মতো শুষে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় এবং বন্যার স্রোতের গতি কমিয়ে আনা হয়।
এই কাজটা হয় তিন ভাগে। প্রথমত, বন্যার পানি যেখান থেকে আসে। স্পঞ্জের মধ্যে যেমন অনেক ছোট ছোট গর্ত দিয়ে পানি শুষে নেওয়া হয়, তেমনিভাবে শহরের মধ্যে অনেক জলাশয় তৈরি করে পানি ধারণ করা হয়।
দ্বিতীয় কাজটি হলো পানির ধারা নিয়ন্ত্রণ। বন্যার পানিকে লম্বালম্বি লাইন ধরে সরিয়ে না নিয়ে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে পানিকে প্রবাহিত হতে দেওয়া এবং গাছপালা, লতাগুল্ম দিয়ে পানির গতি কমিয়ে আনা।
এই পদ্ধতির বাড়তি সুবিধা হলো, শহরের মধ্যে অনেক খোলা জায়গা তৈরি হবে, তৈরি হবে পার্ক, বন্য প্রাণীর বসবাসের জায়গা। জলজ লতাগুল্ম বন্যার পানির দূষণ কাটাতেও সাহায্য করবে।
আর তৃতীয় কাজটি হলো বন্যার পানির প্রস্থানের জায়গা, যে পানি, নদী, লেক কিংবা সমুদ্রে গিয়ে পড়বে।
নিচু জায়গা থেকে মানব বসতি বা দালানকোঠা সরিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক ইউ। তিনি বলেন, বন্যার পানিকে আপনি আটকে রাখতে যাবেন না। একে সরে যাওয়ার পথ করে দিতে হবে।
চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে অধ্যাপক ইউর পরিকল্পনা। বন্যাকে ভয় না পেয়ে তার সঙ্গে বসবাস করাই হচ্ছে তার স্পঞ্জ সিটির মূল ধারণা।
স্পঞ্জ সিটি ধারণাটিকে আমলে নিয়ে পরিকল্পনায় অঙ্গীভূত করে চীন সরকার। এ বিষয়ে ২০১৫ সালে দেশটির সরকার কয়েক দফা নির্দেশনাও দেয়।
২০৩০ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশ শহর ৭০ শতাংশ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করবে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নিজস্ব লক্ষ্য ঠিক করে।
২০১৮ সালে ঝেংঝু শহর কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয় যে তারা ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ ভাগের ৯ ভাগ মূল শহর এলাকা স্পঞ্জ সিটির আওতায় আনবে।
চলতি বছর লেশান শহর কর্তৃপক্ষও ঘোষণা দিয়েছে যে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নগর এলাকাকে তারা সরকার নির্ধারিত স্পঞ্জ সিটির মানদণ্ডের আওতায় নিয়ে আসবে।
চীনের শহরগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্যা প্রতিরোধে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই কাজে ভারী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে তারা। কিন্তু তার ফল আশানুরূপ নয়। ‘স্পঞ্জ ইফেক্ট’ তৈরির জন্য কৃত্রিম জলাভূমি তৈরিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ দরকার।
তবে ঝেংঝুর বন্যা গোটা দেশকেই হতবাক করে দিয়েছিল। এই বন্যা দেখে চীনের অনেকের মনে স্পঞ্জ সিটির বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।
তবে বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে একমত যে ঝেংঝুতে স্পঞ্জ সিটি প্রকল্পের কার্যকারিতা অপ্রমাণিত হয়নি। কারণ, প্রকল্পটি বর্তমানে যে পর্যায়ে রয়েছে, সে অবস্থায় তার কার্যকারিতা মূল্যায়ন করাটা ঠিক হবে না। তাদের মতে, ২০৩০ সালের আগে ঝেংঝুর স্পঞ্জ সিটি প্রকল্পের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা কঠিন হতে পারে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সারা বিশ্বে প্রবল বৃষ্টিপাত ক্রমশ বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। সে জন্য প্রশ্ন উঠেছে, স্পঞ্জ সিটি কি সত্যিই সে রকম ক্ষেত্রে কাজে দেবে? কিছু বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে সন্দিহান। ইউনিভার্সিটি অব নটিংহ্যাম নিংবোর বন্যা ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ফেইথ চ্যান তাদের একজন। চ্যান বলেন, ‘স্পঞ্জ সিটি শুধু হালকা বৃষ্টিপাতের জন্য ভালো হতে পারে।’ তবে এই অধ্যাপকের দাবি, প্রাচীন চীনা প্রজ্ঞা ভুল হতে পারে না। স্থানীয় কর্মকর্তারা তার ধারণাকে ভুলভাবে বা ভেঙে ভেঙে প্রয়োগ করাতেই তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ দেয়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ