ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কেনিয়ার চারণভূমি ও কৃষি অঞ্চলগুলোতে নদী, জলাশয়, বাধসহ প্রাকৃতিক জলের উৎস শুকিয়ে গেছে। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। খরা, করোনা মহামারি ও পঙ্গপালের প্রাদুর্ভাবে কেনিয়ার ২১ লাখের বেশি মানুষ অনাহারে ভুগছে। দেশটিতে বসবাসকারীদের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় খাদ্য ও পানি জরুরি হয়ে পড়েছে।
ভয়াবহ খরার কবলে পড়েছে কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চল। এলাকাগুলোতে গরম আর অনাহারে মারা যাচ্ছে শত শত গবাদি পশু। অনাবৃষ্টির কারণে জমিতে ফসল না হওয়ায় দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য সংকট। জাতিসংঘ বলছে, এখনই ব্যবস্থা না নিলে দেখা দিতে পারে মানবিক বিপর্যয়।
এলাকায় হাঁটতে থাকলে দেখা যাবে যেখানে সেখানে মরে পড়ে আছে গৃহপালিত পশু। মূলত খরার কারণে ফসল না হওয়ায়ই এমন বিপর্যয় ঘটছে। কয়েক মৌসুমে এলাকাটিতে কোনো ফসলেরই চাষ হচ্ছে না। ফলে তীব্র খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘের খাদ্য বিষয়ক সংস্থা, ডব্লিউএফপি।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা বলছে, উত্তর কেনিয়ার ওয়াজির কাউন্টি এলাকার একটি গ্রাম বিয়ামাডো। যে গ্রামের রাস্তার দু’ধারে যেন প্রাণীর মৃত্যুর মিছিল চলছে। ধুলোময় রাস্তার দু’পাশে পড়ে আছে প্রাণীর সারি সারি মরদেহ।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবিতে দেখা যায়, ছয়টি জিরাফের মৃতদেহ একটি শুকনো প্রায় জলাশয়ে পড়ে আছে।
সম্প্রতি আল-জাজিরায় প্রকাশিত একটি ছবিতে দেশটির জিরাফের ওপর খরার প্রভাব কতটা তার ধারণা পাওয়া যায়।
ছবিতে দেখা যায়, কেনিয়ার ওয়াজিরের সাবুলি ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেন্সির ভেতরে ছয়টি জিরাফের মৃতদেহ পড়ে আছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রচণ্ড খরায় খাবার ও পানির অভাবে জিরাফ দলটির মৃত্যু হয়েছে।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিরাফগুলো খাবার ও পানির অভাবে দুর্বল হয়ে যায়। কাছাকাছি একটি প্রায় শুকনো জলাশয় থেকে পান করার চেষ্টা করায় কাদায় আটকে তাদের মৃত্যু হয়।
আল জাজিরার মতে, কেনিয়ার উত্তরের বেশিরভাগ অঞ্চলে সেপ্টেম্বর মাস থেকে স্বাভাবিকের চেয়েও ৩০% কম বৃষ্টিপাত হয়েছে, যার ফলে এ অঞ্চলে তীব্র খরা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টিপাতের অভাবে এ অঞ্চলের বন্য প্রাণীদের ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছে, বেড়েছে খাদ্য ও পানির অভাব।
বোর-আলগি জিরাফ অভয়ারণ্যের একজন কর্মী ইব্রাহিম আলী স্থানীয় নিউজ ওয়েবসাইট দ্য স্টারকে বলেন, ‘বন্যপ্রাণীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। খরায় গৃহপালিত প্রাণীদের সাহায্য করা হয়েছে কিন্তু বন্যপ্রাণীদের হয়নি। যার কারণে বন্য প্রাণীরা হুমকির মুখে পড়েছে’।
তিনি বলেন, ‘নদীর ধারে কৃষিকাজ করায় মানুষ জিরাফদের নদীতে প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছে। যার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে’।
দ্য স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাছাকাছি গারিসা কাউন্টি এলাকায় প্রায় ৪ হাজার জিরাফ খরার কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এদিকে, এ বছরের সেপ্টেম্বরে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা এই খরাকে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে ঘোষণা করেন। কেনিয়ার জাতীয় খরা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গত সপ্তাহে খরায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৫ লাখ মানুষের জন্য একটি জরুরি ‘ত্রাণ নগদ স্থানান্তর কর্মসূচি’ ঘোষণা করেছে।
পানির হাহাকার
এদিকে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানির হাহাকার তৈরি হয়েছে কেনিয়ায়। সাধারণত গৃহস্থলীর কাজের জন্য ঐতিহ্যগতভাবেই নারীরা পানি সংগ্রহ করেন। কিন্তু বৃষ্টির দেখা না মেলায় পানির জন্য তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটাপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ওয়াজির কাউন্টির স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক সোমো দাহির।
কেনিয়ার জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বলছে, গত অক্টোবরে কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় কাউন্টিতে পানির সন্ধানে গড়ে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পথের দূরত্ব পাড়ি দিতে হয়েছে।
মার্কিন সরকারের তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৮৫-২০১৫ পর্যন্ত উত্তর কেনিয়ার তাপমাত্রা প্রতি দশকে ০.৩৪ ° C বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা আরও উপরে উঠবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কেনিয়ার উত্তরের বেশিরভাগ অঞ্চলে সেপ্টেম্বর মাস থেকে স্বাভাবিকের চেয়েও ৩০% কম বৃষ্টিপাত হয়েছে, যার ফলে এ অঞ্চলে তীব্র খরা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টিপাতের অভাবে এ অঞ্চলের বন্য প্রাণীদের ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছে, বেড়েছে খাদ্য ও পানির অভাব।
মার্কিন সরকারের তথ্য বলছে, ফসল ফলানো বা গৃহপালিত পশুকে রাখা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে যত জল বাষ্পীভূত হয়।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মতে, আফ্রিকা অঞ্চলে ২০২০ সাল ছিল এ যাবৎকালের রেকর্ড তৃতীয় সর্বাধিক উষ্ণতম বছর। ২০৫০ সাল নাগাদ এই অঞ্চলের তাপমাত্রা আড়াই ডিগ্রির বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রত্যেকটি বৃদ্ধির ঘটনায় চরম আবহাওয়ার পরিবর্তন বড় হয়ে ওঠে।
কেনিয়ার আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, উত্তর কেনিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চল এই মাসে রৌদ্রোজ্জ্বল এবং গড়-কম বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলে খরার ঘনত্ব এবং তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এর আগে ২০১১ সালের পূর্ব আফ্রিকার খরা, এই অঞ্চল জুড়ে তীব্র খাদ্য সংকট সৃষ্টি করেছিল। প্রায় ১ কোটি মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছিল এবং এর ফলে হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল।
সমস্যা পূর্ব-আফ্রিকাজুড়েই
এমন দৃশ্য প্রায় গোটা পূর্ব আফ্রিকাজুড়ে। কেনিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়াজুড়ে ভয়ঙ্কর খরার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গবাদি পশুরাই। আর সাভানা অঞ্চলের মানুষের মূল জীবীকাই পশুপালন এবং পশুচারণ। অথচ পশুচারণের জন্য একটি চারণভূমিও বেঁচে নেই। নেই সামান্য পাণীয় জলও।
শুধুই গবাদি পশুরা নয়, সংরক্ষিত অরণ্যের প্রাণীদের অবস্থাও একই রকম। ইথিওপিয়ায় এক মাসে ১১টি জিরাফের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে বনবিভাগ। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনো রাস্তাও খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।
আর এই খরা পরিস্থিতি মিটতে এখনও অন্তত ৮ মাস বাকি। তারপরেও আগামী বর্ষায় প্রয়োজনমতো বৃষ্টি হবে কিনা, তা নিয়ে নিশ্চিত নন কেউই। ২০১১ সালের পর এমন ভয়াবহ খরার মুখে পড়েনি পূর্ব আফ্রিকা।
গত ৪ মাস ধরেই পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে জানিয়ে আসছেন ইথিওপিয়া, সোমালিয়া এবং কেনিয়া সরকার। আন্তর্জাতিক সাহায্যও চেয়েছেন তারা। অথচ এর মধ্যে কপ-২৬ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেও এই খরা সমস্যার সমাধানের প্রায় কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে উঠছে। যখন সম্বল অতি সামান্য, তখন সমস্ত মানবিক অনুভূতি হারিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই সামান্য খাদ্য-পাণীয় যা পাচ্ছেন, মানুষ আগে নিজের জীবন বাঁচাতে কাজে লাগাচ্ছেন।
অবশ্য পূর্ব আফ্রিকার অধিকাংশ মানুষই জানেন, পশুরা না বাঁচলে তারাও বাঁচবেন না। পশুপালনই যে তাদের জীবীকা। কিন্তু গবাদি পশুদের বাঁচানোর কোনো উপায়ও যে নেই। এক একটি পরিবার, যাদের ১০০-১৫০টি পোষ্য ছিল আগে, সেই সংখ্যাটা নেমে এসেছে ৩০-৪০-এর মধ্যে। জীবিত প্রাণীদের অবস্থাও সংকটজনক।
ইতিমধ্যে ৭০ শতাংশ গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছে পূর্ব আফ্রিকা জুড়ে। হয়তো এই খরা মিটতে মিটতে আর একটি প্রাণীও বেঁচে থাকবে না। তখন পশুপালক মানুষদের জীবীকা কী হবে, জানেন না কেউই।
জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়ে জানিয়েছে, ইথিওপিয়া, কেনিয়া এবং সোমালিয়ায় যে দুর্যোগ দেখা দিয়েছে তা গত ৬০ বছরে দেখা যায়নি৷ অনেকেই প্রশ্ন করতে পারে আফ্রিকার এই অঞ্চলে খরা বা দুর্ভিক্ষের কারণ কী? শুধু কি বৃষ্টির অভাবেই এই খরা দেখা দিয়েছে নাকি এর পেছনে অন্য কোন কারণ রয়েছে?
জাতিসংঘের জরুরি শিশু তহবিল ইউনিসেফের কর্মী ক্রিস্টফার টাইডি জানান, ‘এই অবস্থার জন্য অনেকগুলো কারণ এক সঙ্গে কাজ করছে৷ প্রথমত, সারা বিশ্বে খাবার-দাবারের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে৷ এছাড়া খরা চলেছে অনেক দিন ধরে৷ সেই সময়ে কোন ফসল ফলানো যায়নি৷ আর সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি করেছে সোমালিয়ার ভিতরকার সংঘর্ষ৷ এসব সংঘর্ষের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজস্ব গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে৷ তারা আর ফিরে আসেনি’৷
টাইডি জানান, দুর্ভিক্ষের কারণে খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে মানুষগত কয়েক মাস ধরেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে এ ধরণের একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন আমরা হবো। আক্ষেপের সঙ্গে তিনি আরও জানান যে, ‘কোন কোন সময় আমরা দেখি যে এ ধরণের কোন সংকট যতক্ষণ না তার পূর্ণাঙ্গ শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে ততক্ষণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের টনক নড়ে না৷ এটা খুবই দুঃখজনক’।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৮
আপনার মতামত জানানঃ