নারী নির্যাতনে চতুর্থ বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে শিশু নির্যাতনের চিত্র উঠে আসছে। এর বাইরেও নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। নিরপরাধ শিশুরা শিকার হচ্ছে খুন, ধর্ষণ কিংবা ভয়াবহ নির্যাতনের। এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দৃষ্টান্ত খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। অনেক সময় ভোক্তভোগী আইনের আশ্রয় নিলেও অপরাধী ফাঁকফোকরে ছাড়া পেয়ে যায়। করোনা মহামারিতে মানুষ যখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে, তখনও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ নেই বরং বেড়েছে।
আজ মঙ্গলবার জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম আয়োজিত এক অনলাইন গোলটেবিল আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৮১৩ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ১৪৭ কন্যাশিশু অপহরণ ও পাচারের শিকার হয়েছে। বাল্যবিবাহ বেড়েছে ১০ শতাংশ। কন্যাশিশুরা সমাজের প্রতিটি স্তরে নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হয়ে ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেয়েদের প্রতি চরম বিদ্বেষ কমিউনিটি পর্যায়ে দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থা মোকাবিলায় সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।
‘টেকসই উন্নয়নে কন্যাশিশুর নিরাপত্তা ও জেন্ডার সমতা’ শিরোনামের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, কন্যাশিশুকে সমান সুযোগ দিলে সে–ও সফল হতে পারে। কন্যাশিশুরা আজ সব জায়গায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। করেনাকালে কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা আরও বেড়েছে। সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করেও ধর্ষণ কমানো যায়নি। তিনি বলেন, আগামীর কন্যাশিশুকে সুসংহতভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়ার লক্ষ্যে দল–মতনির্বিশেষে সবাইকে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে হবে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোমা দে। তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়নের মানে হচ্ছে সবার জন্য উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর জন্য ১৭টি অভীষ্ট ও ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেশগুলোকে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার তাগিদ দিয়েছে। যাতে সব পর্যায়ে নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য বিলোপ হয় এবং সর্বস্তরে নারীর নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়। এই লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে পারলে বাংলাদেশে সক্রিয় ও আত্মনির্ভরশীল তরুণ প্রজন্ম গড়ে উঠবে। তারা ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতার এক সমাজ গড়ে তুলবে।
তিনি বলেন, সমাজে নারীর প্রতি চরম বিদ্বেষ রয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্য দিয়ে সেসব বিদ্বেষ এখন কমিউনিটি পর্যায়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
স্বাগত বক্তব্যে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার বলেন, জীবিকা, সম্পদ, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে মেয়েদের অগ্রগতি হলেও পুরুষের তুলনায় এখনো তাঁরা পিছিয়ে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব পর্যায়ে নারীর সম অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বাল্যবিবাহ রোধে সবাইকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাল্যবিবাহের মাধ্যমে কন্যাশিশুর অধিকার হরণ করা হচ্ছে। করোনাকালে ১০ শতাংশ বাল্যবিবাহ বেড়েছে। এদিকে সবাইকে দৃষ্টি দিতে হবে।
সভাপ্রধানের বক্তব্যে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সহসভাপতি শাহীন আক্তার বলেন, কন্যাশিশুদের অধিকার রক্ষার দায়বদ্ধতা থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
কন্যাশিশুকে সমান সুযোগ দিলে সে–ও সফল হতে পারে। কন্যাশিশুরা আজ সব জায়গায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। করেনাকালে কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা আরও বেড়েছে। সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করেও ধর্ষণ কমানো যায়নি।
সম্প্রতি জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের ‘কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন-২০২১’এ জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৮১৩ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ১২৭ জন কন্যাশিশুকে। এর মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার ৫২৩ জন, গণধর্ষণের শিকার ১১০ জন ও ৭৯ জন প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
ধর্ষণ ছাড়াও কন্যাশিশুদের প্রতি বিভিন্ন মাত্রায় নির্যাতন করা হচ্ছে। এ চিত্র তুলে ধরে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৮ মাসে ১১২ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে চারজন বিশেষ শিশুও রয়েছে।
কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৮ মাসে ১৯৩ কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার অন্যতম কারণগুলো ছিল—পারিবারিক দ্বন্দ্ব, পূর্বশত্রুতার জের, ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন। এ ছাড়াও বিগত কয়েক মাসে ২৪ কন্যাশিশুকে বিভিন্ন স্থানে ফেলে রেখে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
গত ৮ মাসে ১৫৩ জন কন্যাশিশু আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। নেপথ্যের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়—স্কুল বন্ধ থাকায় হতাশা, পারিবারিকভাবে মতানৈক্য বা দ্বন্দ্ব, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়া এবং শারীরিকভাবে যৌন নির্যাতন যা প্রকাশ করার মতো অভয় আশ্রয়স্থলের অভাব।
কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের অভিযোগ—ধর্ষণের ঘটনায় কেবলমাত্র জিডি, কেস ফাইল এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক অল্পসংখ্যক আটকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। চূড়ান্ত শাস্তির কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। আটককৃত ব্যক্তিদের অধিকাংশই জামিনে মুক্তি পেয়ে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদেরকে বিভিন্ন রকম হুমকি দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয় না। সেক্ষেত্রে পরিবার থেকে প্রতিটি প্রজন্ম শিখছে মেয়েরা মানুষ নয়, তারা শুধু ব্যবহারের জন্য। এভাবে পরিবার থেকেই মূলত নারীর প্রতি অসম্মানের শুরু। এতে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের হার। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের কথা বলছে রাষ্ট্র। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা নারীদের সম্মানের জায়গায় তুলে ধরতে পারছি না।’
তারা বলেন, ‘পরিবার থেকেই নারীদের সম্মান দেওয়ার শিক্ষাটা জরুরি। পাশাপাশি আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় যা রয়েছে তা একপ্রকার ইঁদুর দৌড়ের মতো। আমরা শুধু দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। মানবিক শিক্ষা না শিখে ডিগ্রির পেছনে দৌড়াচ্ছি। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানবিক শিক্ষা শুরু করা দরকার।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫১
আপনার মতামত জানানঃ