গবেষকেরা আশা করছেন মায়ের পেটে নয়, আগামী দুই দশকের মধ্যেই কৃত্রিম উপায়ে শরীরের বাইরেই মানবশিশুর জন্ম-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এর নাম এক্টোজেনেসিস— এটি মানবদেহের বাইরে কৃত্রিম জরায়ুতে ভ্রুণ রেখে তা আস্তে আস্তে বড় করবে।
সন্তানের জন্যে মানুষের যে সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাতে মৌলিক বদল ঘটাতে যাচ্ছে এক্টোজেনেসিস। প্রাণী শরীরের বাইরে ভ্রুণের বেড়ে ওঠার পদ্ধতির নাম এক্টোজেনেসিস। মানুষ, অন্যান্য প্রাণী, এমনকি ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এই পদ্ধতি।
যেভাবে কাজ করে এই যন্ত্র
২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা একটি কৃত্রিম গর্ভ তৈরি করেন। ভবিষ্যতে প্রিম্যাচিউর বা অকালে জন্ম নেয়া শিশুদের বাঁচিয়ে রাখতে এটা ব্যবহার করা যাবে বলে সে সময় ধারণা করা হয়। এই ‘অতিরিক্ত-জরায়ু সহায়তা’ যন্ত্রটি ভেড়ার উপর পরীক্ষা করে সাফল্যও পাওয়া গিয়েছিল।
গবেষকরা বলছেন, তাদের উদ্দেশ্য হলো প্রিম্যাচিউর শিশুদের ফুসফুস এবং অন্যান্য প্রত্যঙ্গ যাতে সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। এই যন্ত্রটি মূলত একটি প্লাস্টিক ব্যাগ, যার ভেতরে রয়েছে কৃত্রিম অ্যামনিওটিক ফ্লুইড। এটার ভেতরের পরিবেশ অনেকটা জরায়ুর ভেতরের পরিবেশের মতো।
এই প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধিত হলে, মাতৃগর্ভ ছাড়াই জন্মাবে শিশু। কৃত্রিম জরায়ুর মাধ্যমে বিকশিত হবে ভ্রূণ। প্রযুক্তির হাত ধরেই এই শতাব্দী শেষের আগেই হয়ত এমন সম্ভব হবে। বিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম ‘এক্টোজেনেসিস’।
বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী জে. বি. এস হ্যালডেন এই শব্দের রচয়িতা। হ্যালডেন অনুমান করেছিলেন, ২০৭৪ সালের মধ্যে প্রায় ৭০% মানবশিশুর জন্ম এভাবেই হবে।
ব্রিটিশ-ভারতীয় এই বিজ্ঞানীর অনুমান কতটা সফল হবে তা হয়ত সময়ই বলবে, কিন্তু এক্টোজেনেসিসের পথে কতটা এগিয়েছে প্রযুক্তি? ১৯৯০ সালে জাপানি বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম অ্যামনিয়টিক তরলে একটি ছাগলের ভ্রূণকে অনেকদিন জীবিত রাখতে সক্ষম হন।
গত কয়েক দশকে নবজাতকের পরিচর্চা ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। এখন বাইশ সপ্তাহের আগে মাতৃগর্ভ থেকে ভ্রূণ স্থানান্তরিত হলে তাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।
যেসব নারী সন্তান ধারণে অক্ষম এবং জরায়ুতে যাদের ভ্রূণ বাড়ে না তাদের জন্যে কাজ করেছেন ড. হেলেন হাং-চিং লিউ। তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজনন ঔষধ ও অনুর্বরতা কেন্দ্রের পরিচালক। ২০০৩ সালে তিনি এবং তার দল ইঁদুরের ভ্রূণ বড় করার চেষ্টায় প্রায় পুরোপুরি সফল হন। এই প্রক্রিয়াতে তারা বায়ো-প্রকৌশল প্রয়োগ করা এক্সট্রা জরায়ুতে ইনিজিনিয়ারিং করা অ্যান্ডোমেট্রিয়াম টিস্যু যোগ করেছিলেন।
২০১৫ সালের দিকে, ড. হেলেন হাং-চিং লিউ ১০ দিন ধরে একটি মানব ভ্রূণের বৃদ্ধি ঘটিয়েছেন কৃত্রিম জরায়ুতে। তার কাজের আইনগত সীমাবদ্ধতা ছিল। এই আইন অনুযায়ী এই ধরনের গবেষণা কাজের জন্য তিনি ১৪ দিন সময় পান। এটা জটিল হলেও তার লক্ষ্য ছিল বহিস্থ জরায়ুকে কাজ করানো।
যদিও বায়ো টেকনোলজির দ্রুত উন্নতির ফলে, স্ত্রী-দেহ ছাড়াও কেবল নিষিক্ত ডিম্বাণু দিয়েই কৃত্রিম জরায়ুতে ভ্রূণের বিকাশ করানো যেতে পারে। এর ফলে একদিকে যেমন প্রিম্যাচিওর বার্থ রেট কমবে, তেমনই কেবল ডিম্বাণুর সাহায্যেই সমকামী পুরুষদের সন্তান লাভের স্বপ্নও পূরণ হবে। সারোগেসির সাহায্য নিতে অনিচ্ছুক অনেক দম্পতিই সন্তান লাভ করতে পারেন এই পদ্ধতিতে। এর ফলে সারোগেট মাদারের প্রয়োজনীয়তাও মিটবে। সেইসঙ্গেই কমবে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যুর হার। ভ্রূণ অসুস্থ হয়ে পড়লে ওষুধও দেওয়া যাবে সহজেই।
২০০১ সালে আবিষ্কৃত হয় এক্টোজেনেসিস। ইঁদুরের গর্ভের সঙ্গে প্লাসেন্টা মেশিন যুক্ত করে এক্টোজেনেসিস করা হয়। গবেষকরা মনে করছেন এর ফলে যেহেতু সন্তানের মনিটরিং করা অনেক সহজ হবে, মৃত শিশু প্রসবের প্রবণতাও অনেক কমবে।
এক্টোজেনেসিস প্রযুক্তি আপাতভাবে দেখতে সহজ হলেও খুব জটিল একটি প্রক্রিয়া। কৃত্রিম গর্ভে প্রয়োজন কৃত্রিম জরায়ু, অক্সিজেন ও ভ্রুণের বেড়ে ওঠার প্রয়োজনীয় পুষ্টি। বর্জ্য পদার্থ বের করতে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড স্যাকেরও প্রয়োজন। এই পুরোটাই যুক্ত থাকবে প্লাসেন্টা মেশিনের সঙ্গে। যেখানে কেবলের মাধ্যমে মনিটর যুক্ত করে হার্ট রেট থেকে ভ্রুণের বৃদ্ধির সবকটি ধাপই মনিটর করা হবে।
আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?
যদি কোনও কারণে কোনও মহিলার জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে বা অন্য কারণে তিনি স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান ধারণ করতে অক্ষম হন, তবে এই পদ্ধতিতে সন্তানের জন্ম দিতে পারবেন তিনি।
গবেষকরা বলছেন, যন্ত্রটি তৈরির কাজ প্রায় শেষ। কিছু আইন ও নৈতিক জটিলতার জন্য আপাতত চালু করা যাচ্ছে না এর ব্যবহার। ২০৩৪ সালের মধ্যেই ব্যবহারের উপযোগী হয়ে যাবে বলেই তারা আশাবাদী। এই যন্ত্র চালু হলে সন্তান প্রসবের সময় মা বা সন্তানের মৃত্যুর হার কমবে।
তবে কৃত্রিম গর্ভ নিয়ে বিরোধিতায়ও সরব হয়েছেন একদল চিকিত্সা বিজ্ঞানী। তাদের দাবি, এই যন্ত্র মানুষকে আরও যান্ত্রিক করে তুলবে। মা ও সন্তানের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক নষ্ট হবে।
যদিও এক্টোজেনেসিসের মানে দাঁড়াচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে সন্তান জন্মদানের দায়িত্ব আর নারীদের বইতে হবে না। অথবা নয় মাস পেটে বাচ্চা বহন করার সময় এরকম বিরক্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখিও হতে হবে না যে, আমি যে পানি পান করি তা কি আমার সন্তানের মস্তিষ্কের বৃদ্ধিতে খারাপ প্রভাব ফেলছে? আমাকে যে ফ্লু ভাইরাস আক্রান্ত করেছে তা কি আমার সন্তানের শরীর নষ্ট করে ফেলবে?
বরং বেশি গুরুত্বের দিক জন্ম নেওয়া শিশুর স্বাস্থ্য। প্রাকৃতিকভাবে জন্মদানে ঝুঁকি অনেক বেশি। এক্টোজেনেসিস তার নিরাপদ বিকল্প হতে পারে। এই প্রক্রিয়াতে ভ্রূণের প্রতিটি হার্টবিট, পা নাড়ানো, প্রতিটি মুহূর্ত যত্নের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
একেবারে জাইগোট অবস্থা থেকে শিশুর প্রথম শ্বাস গ্রহণ পর্যন্ত। শিশু যে পুষ্টি পায় তা মাপা হয়, প্রতিটি মুহূর্তের ভিডিও হয়, সঠিক টাইমিং এর জন্য প্রতিটি হার্টবিট বিশ্লেষণ করা হয় এই প্রক্রিয়ায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ