চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ওয়েই ফেঙ্গির ঢাকা সফর শেষ মুহূর্তে এসে বাতিল হয়েছে। চীন বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব হওয়ায় এটি দুঃসংবাদ বলে মনে করছেন কূটনীতি বিশ্লেষকরা। এ নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনেও চলছে নানা আলোচনা। সরকারি পর্যায়ে কোনো সফর বাতিল হলে তা কূটনৈতিক চ্যানেলে আগভাগেই জানানো হয়, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সফর বাতিল হয় সাধারণত রাজনৈতিক কারণে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকটি বৈঠক স্থগিত হয়েছে। এবার চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফরের প্রস্তুতি নিয়েও শেষ মুহূর্তে স্থগিত করেছে ঢাকা। চীন-ভারতের চলমান রাজনৈতিক বিরোধ এখানে ভূমিকা রাখছে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
রবিবার নেপালি গণমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্ট জানায়, কাঠমান্ডুর ঝটিকা সফর শেষে ১ডিসেম্বর তার ঢাকা আসার কথা ছিল। নেপাল থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সফর করে বেইজিং ফিরবেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এ বিষয়ে বেইজিংয়ের বাংলাদেশ দূতাবাসের ডিফেন্স অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম মাহবুব-উল-আলমের সাথে যোগযোগ করা হলে স্টেটওয়াচকে তিনি জানান, সফরের বিষয়ে কিছুই জানে না দূতাবাসের প্রতিরক্ষা উইং। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফরের প্রস্তুতি ছিল দু’পক্ষ থেকেই। সময় সুবিধাজনক না থাকায় সফরটি স্থগিত হয়েছে। এখন উভয়ের সুবিধাজনক সময় খোঁজা হচ্ছে এবং শিগগিরই তা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকার কর্মকর্তারা।
মাত্র একদিন আগেই বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অন্য একটি বৈঠক স্থগিত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ২৯ নভেম্বরের পূর্ব নির্ধারিত ওই বৈঠকটি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ সময়ে করোনাভাইরাসকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে ভারতীয় প্রতিনিধিরা বৈঠকে অংশগ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করায় তা স্থগিত হয়ে গেছে।
চীন-ভারত সীমান্তে উত্তেজনার মধ্যেই দুই দিনের নেপাল সফর শেষে গত শুক্রবার দেশে ফিরেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। দিল্লির বিদেশ সচিবের সফরের রেশ না কাটতেই ঝটিকা সফরে কাঠমান্ডু গেলেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেঙ্গি। তবে বাতিল হলো ওয়েই ফেঙ্গির ঢাকা সফর।
সীমান্ত ইস্যুতে বেইজিং ও নয়াদিল্লির পরস্পরবিরোধী অবস্থান দৃঢ় হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক কূটনীতির প্রেক্ষাপটে উভয় সফরকেই তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এসব ঘটনা নির্দেশ করছে যে, ভারত ও চীন উভয় দেশই প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোতে তৎপরতা বাড়িয়েছে। সরকারি বৈঠকগুলো বাতিলের সঙ্গে এর যোগসাজশ অসম্ভব নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামানের মতে, বাংলাদেশের সরকারের স্থিতিশীলতা ও চীনের প্রতি পুরোপুরি আস্থার সম্পর্কে নিশ্চিত নয় বেইজিং। ধীরে ধীরে সেটি দৃশ্যমান হচ্ছে। বেইজিং-নয়াদিল্লি উত্তেজনায় ঢাকার সুস্পষ্ট অবস্থান প্রত্যাশা করে চীন।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভৌগলিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে দেখা হয় বাংলাদেশকে। ভারত ও চীন দুই দেশের সাথেই ভারসাম্য বজায় রেখে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার নীতিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ভারত সরকার তার ‘লুক ইস্ট’ নীতি এবং চীন সরকার তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখতে চায়। দুই দেশের এই বিপরীতমুখী চাওয়ার মধ্যে চিড়েচ্যাপ্টা হওয়ার দশায় বাংলাদেশ।
বরাবরই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ঐতিহাসিক বলে দাবি করা হয় দু’পক্ষ থেকেই। বাংলাদেশের দাবিই এক্ষেত্রে জোরালো। যদিও তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত হত্যাসহ অমীমাংসিত নানা ইস্যুতেই দীর্ঘদিন ধরে কূটনৈতিক দরকষাকষিতে অলাভজনক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। চীন তার সুযোগ নেবে, বিশ্লেষকরা এটা আগেই বলেছিলেন। এখন চীন তার প্রভাব খাটানো শুরু করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার উচ্চ পর্যায়ের কিছু সরকারি বৈঠক স্থগিতের পর চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে এসেছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অঞ্চলে চীনের কৌশলগত স্বার্থ সুস্পষ্ট এবং তা ভারতের স্বার্থের বিরোধী। যে কারণে ভারত জোরালোভাবে চায় তার প্রতিবেশিরা যেন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ না হয়। চীনও তার বিনিয়োগের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশে ভারতের উদ্যোগগুলোকে মেনে নেবে না বলে মত অধ্যাপক শাহীদুজ্জামানের। একইসাথে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশে ভারত একটি বাস্তব বাধা বলেও মনে করেন তিনি।
শহীদুজ্জামান বলেন, “ভারত কোনভাবেই চায় না বাংলাদেশের অর্থনীতি ভারতকে ছাড়িয়ে যাক। এটি মোদী সরকারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য অপমানজনক এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে এই ধরনের সংবাদ দেশটির অভ্যন্তরে নাটকীয়, অপমান।“
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশকে সঠিক নীতি গ্রহণ করতে হবে। চীনের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেলে থমকে যাবে সরকারের অনেক উন্নয়ন প্রকল্পও। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলেও জানান অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান।
এসআর/আরা/২৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ