রংপুরের হারাগাছে পুলিশের বিরুদ্ধে তাজুল ইসলাম (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বুধবার (৮ ডিসেম্বর) বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
রংপুরের জেলা ও দায়রা জজকে প্রধান করে বিচার বিভাগীয় কমি জেলা প্রশাসকের একজন প্রতিনিধি ও রংপুর পুলিশ কমিশনারের একজন প্রতিনিধিকে তদন্ত কমিটিতে রাখতে বলা হয়েছে।
আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এই কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্ত।
এর আগে গত ৩ ডিসেম্বর রংপুরের হারাগাছে পুলিশের বিরুদ্ধে তাজুল ইসলাম (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় পুলিশের গঠন করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এছাড়া ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনও দাখিল করতে বলা হয়েছে। এসব প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়েছে। তবে প্রতিবেদনগুলোতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি আদালত। এ কারণে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে দিলেন হাইকোর্ট।
গত ২ নভেম্বর রংপুরের হারাগাছে পুলিশের বিরুদ্ধে তাজুল ইসলাম (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানতে চান হাইকোর্ট। রংপুরের পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার বিস্তারিত ও এ ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা আদালতকে জানাতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্তকে বলা হয়। বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্ব-প্রণোদিত হয়ে এই আদেশ দেন।
ঘটনাটি আদালতের নজরে আনেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত পুলিশি নির্যাতনে তাজুল ইসলামের মৃত্যু নিয়ে প্রতিবেদন পড়ে শোনান।
জানা যায়, ঘটনার দিন সন্ধ্যা সাতটার দিকে মাদকসেবনের অভিযোগে তাজুল ইসলামকে হারাগাছ থানার পুলিশ আটক করে। এর কিছুক্ষণ পরেই তাজুল ঘটনাস্থলে মারা যান। তাকে পুলিশ পিটিয়ে মেরেছে এমন কথা ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় জনগণ হারাগাছ থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এসময় পুলিশের একটি গাড়ির সামনের অংশ ভাংচুর, হারাগাছ থানার ডিউটি অফিসারের রুম, নারী সেবা ডেস্কসহ তিনটি কক্ষ ভাংচুর করা হয়। ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ জনতা ও পুলিশের মাঝে কয়েক ঘন্টা উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করে। পরে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ লাইন থেকে অতিরিক্ত পুলিশ পাঠানো হয়। এ ঘটনায় উভয়পক্ষের কমপক্ষে অর্ধশতজন আহত হয়েছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে হারাগাছ পৌর এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, পুলিশ ওদিন সন্ধ্যায় নয়া বাজার এলাকায় তাজুলকে আটক করে হ্যান্ডকাপ পড়িয়ে নিযার্তন করে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় তাজুল। এছাড়া পুলিশ তাজুলের স্বজনদের থানায় ডেকে এনে কয়েকটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়। এ ঘটনায় দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিচার দাবি করেন তারা।
এদিকে পুলিশের মারপিটে তাজুল ইসলামের মৃত্যুর অভিযোগে থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ ও ভাংচুরের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা দায়ের করেছে। এর একটি থানায় হামলা, ভাংচুর ও সরকারি কাজে বাধা প্রদানের মামলা। অপরটি ইউডি মামলা, যা অপমৃত্যুর ক্ষেত্রে দায়ের করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘কারাগারগুলোতে নির্যাতন একটি প্র্যাকটিসে (অভ্যাস) পরিণত হয়েছে। এখন থেকেই যদি এগুলো শক্ত হাতে মোকাবিলা করা না যায়, তাহলে এসব বন্ধ করা খুব কঠিন হবে।
তারা বলেন, ‘অপরাধীরা অপরাধ করবেই। কিন্তু আইনের লোক তো অপরাধীর মতো আচরণ করতে পারে না। তাদের চাকরিতে প্রবেশের আগে যে প্রশিক্ষণ তা আরও যুগোপযোগী, মানবতা উপযোগী এবং কর্তব্যনিষ্ঠ উপযোগী হওয়া উচিত।’
তারা বলেন, ‘আসলে আমাদের দেশে কারগারগুলো প্রযুক্তিনির্ভর নয়। এর কারণ হচ্ছে, কর্তৃপক্ষের ধারণা যে, মারধর-নির্যাতন না করলে কেউ তথ্য দেয় না, দোষ স্বীকার করে না। ক্ষমতা জাহির করার জন্য, এক ধরনের ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে এই চর্চা ও মানসিকতা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তিগত রেশ মেটানোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে দেশের আইন। আইনের সাথে জড়িত কর্তাব্যক্তিরা এর অপব্যবহারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হাসিলের রেওয়াজ প্রচলিত। কেন নির্যাতন করা হয়েছে এবিষয়ে আসামিদের তদন্ত করলে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে। কদিন আগে বন্দীকে নারীসঙ্গের ব্যবস্থা করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল কেন্দ্রীয় কারাগারের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এখন অমানবিকভাবে বন্দীকে নির্যাতনের অভিযোগ এলো। এ থেকে দেশের কারাগারগুলোর এক ভয়ানকতম চিত্র উঠে আসে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তারা এর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে আসামিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা ক্রমশ বেড়েই চলছে। আর এসবের সবকটাই ক্ষমতার অপব্যবহারকে কেন্দ্র করেই হয়ে থাকে বলে মনে করেন তারা।
তারা বলেন, পুলিশে ঢোকার পর স্বাভাবিক একজনের ভেতরেও আশ্চর্য এক পরিবর্তন আসে। স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার চূড়ান্ত ভেবে তারা যা ইচ্ছা তা করার মানসিকতা নিয়ে দাপটের সাথে চলতে থাকেন। ফলে ঘর থেকে বাহির কেউ তাদের কুৎসিত হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আইনের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাশীল না হলে পুলিশের বিরুদ্ধে এমন আরও অসংখ্য অভিযোগ আসতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪২
আপনার মতামত জানানঃ