চাঁদে একটি রহস্যময় বস্তুর সন্ধান পেয়েছে চীনা রোভার। যে বস্তুকে ‘রহস্যময় কুঁড়েঘর’ হিসেবে অভিহিত করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। স্পেসডটকমের একটি প্রতিবেদনে এমনই জানানো হয়েছে।
চাঁদের একটি দিকের সঙ্গে পৃথিবীর চিরস্থায়ী আড়ি। মুখ করে থাকে পৃথিবীর ঠিক উল্টো দিকে। দূরত্ব বেশি বলে অঞ্চলটিকে আমরা বলি ‘ফার সাইড অব দ্য মুন’। ভন কারমান ক্রেটারের অবস্থান সেখানেই। বছর তিনেক হলো, এই ক্রেটারে রোবটযান পাঠিয়েছে চীন। ইয়ুতু-২ নামে রোবটযানটির ক্যামেরায় সম্প্রতি ধরা পড়েছে অদ্ভুত এক ‘কুঁড়েঘর’।
ভন কারমার ক্রেটারে কাজ চালাচ্ছে চীনা ইউতু ২ রোভার। যা চাঁদের অন্যতম বড় এবং গভীরতম গর্ত বলে দাবি করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, চাঁদে পৌঁছানোর প্রায় দু’বছর পর সেই ‘রহস্যময় কুঁড়েঘর’-এর সন্ধান পেয়েছে ইউতু ২ রোভার। আপাতত যেখানে সেই রোভার আছে, তার ৮০ মিটার দূরে সেই রহস্যময় বস্তুর সন্ধান মিলেছে।
আওয়ার স্পেস নামে একটি চীনা ভাষার চ্যানেলে (চীনা জাতীয় মহাকাশ প্রশাসনের অনুমোদন প্রাপ্ত চ্যানেল) নিয়মিত সম্প্রচারিত ইউতু ডায়েরি ২-কে উদ্ধৃত করে স্পেসডটকম জানিয়েছে, হঠাৎ উত্তরের আকাশে একটি রহস্যময় ঘনক দেখা গিয়েছে। সেটা এমনভাবে আছে, দেখে মনে হচ্ছে যে সেটা যেন একটা ‘কুঁড়েঘর’। যা হঠাৎ সামনে এসেছে। ‘ক্র্যাশ ল্যান্ডিংয়ের পর এটা কি ভিনগ্রহের বাসিন্দারা এই বাড়ি তৈরি করেছে? নাকি চাঁদে আসা কোনো রোভার, যা আগে এসেছিল?’
সেইসঙ্গে ওই ‘রহস্যময় কুঁড়েঘর’-এর ছবিও সামনে আনা হয়েছে।
ছবিটি ঘোলা—তাতে যথারীতি চাঁদের নির্বিশেষ পাথুরে ভূমি। তবে কিছুটা দূরে মাটি থেকে খানিকটা উঁচু চারকোনা এক আকৃতি দেখা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইচ্যাটের চীনা সংস্করণে এক পোস্টে চায়না ন্যাশনাল স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (সিএনএসএ) সে আকৃতিকে ‘রহস্যময় কুঁড়েঘর’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। খানিকটা মজা করেই তারা লিখেছে, ‘এটা কি জরুরি অবতরণের পর এলিয়েনদের তৈরি ঘর? নাকি চাঁদকে জানার জন্য পূর্বসূরিদের পাঠানো কোনো নভোযান?’
সে দুটোর কোনোটা না হওয়াই বেশি স্বাভাবিক বলে জানানো হয়েছে সায়েন্স অ্যালার্টের প্রতিবেদনে। বরং চাঁদে যে বস্তুর অভাব নেই, হয়তো তেমনই কোনো পাথরখণ্ড সেটা। তবে নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই এখনই। আর সে কারণে সেটি আদতে কী, তা বুঝতে বস্তুটির কাছাকাছি পাঠানো হবে ইয়ুতু-২। বর্তমানে রোবটযানটি যেখানে আছে, সেখান থেকে বস্তুটির দূরত্ব ২৬০ ফুটের মতো। তবে দুই থেকে তিন মাসের আগে সেটুকু দূরত্ব পেরোবে না রোবটযানটি।
ইয়ুতু-২ চলে সৌরশক্তিতে। সূর্যের আলো না পেলে, বিশেষ করে রাতে সেটি চলতে পারে না। আর চাঁদের রাত দুই সপ্তাহ লম্বা। আবার অত্যধিক গরম হওয়ার সূর্য ঠিক মাথার ওপরে থাকলে ভয়ে সেটি চালানো হয় না। তা ছাড়া খানাখন্দ এড়িয়ে পথ বুঝেশুনে এমনিতেই ধীরে ধীরে চলে রোবটযানটি।
ক্র্যাশ ল্যান্ডিংয়ের পর এটা কি ভিনগ্রহের বাসিন্দারা এই বাড়ি তৈরি করেছে? নাকি চাঁদে আসা কোনো রোভার, যা আগে এসেছিল?’
আরও ঝামেলা আছে। যদি ধরে নেওয়া হয়, বস্তুটি মাটি থেকে খানিকটা উঁচু হয়ে থাকা পাথরখণ্ড, সে ক্ষেত্রে হতে পারে কাছাকাছি নতুন তৈরি কোনো গর্ত আছে। যে আঘাতে গর্তটি তৈরি হয়েছে, সে আঘাতেই বেরিয়ে এসেছে পাথরখণ্ডটি। চাঁদের ক্ষেত্রে মহাকাশ থেকে ছুটে আসা বস্তুর এমন আঘাত আগেও অনেকবার হয়েছে।
তা ছাড়া চাঁদের ফার সাইডে এর আগেও অদ্ভুত কিছুর খোঁজ পেয়েছে ইয়ুতু-২। ২০১৯ সালে অনেকটা জেলের মতো পদার্থের খোঁজ পেয়েছিল। পরে জানা যায়, সেটি আসলে কাচ, যা চাঁদের পাথর গলে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে।
পৃথিবীর যেমন বায়ুমণ্ডল আছে, চাঁদের তেমন নেই। এতে মহাকাশ থেকে পাথরখণ্ড ছুটে এলে সরাসরি চন্দ্রপৃষ্ঠে আঘাত হানে। পৃথিবীর ক্ষেত্রে বায়ুমণ্ডলের স্তর পেরোনোর সময় পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়।
‘রহস্যময় কুঁড়েঘর’ যদি এলিয়েনের অস্তিত্ব প্রমাণের মতো তেমন রহস্যময় না-ও হয়, তবু সেটি চাঁদ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বাড়াতে পারে। যেমন সেটা যদি চন্দ্রপৃষ্ঠের নিচ থেকে উঠে আসা পাথরখণ্ড হয়, তবে চাঁদের মাটির ওপরের স্তরের নিচে থাকা পাথরের গঠন সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই সিএনএসএর বিজ্ঞানীরা তা নিয়ে গবেষণা শুরু করবেন।
সায়েন্স অ্যালার্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চাঁদে বস্তুর অভাব নেই, হয়তো তেমনই কোনো পাথরখণ্ড হবে সেটা। তবে নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই এখনই। আর সে কারণে সেটি আদতে কী, তা বুঝতে বস্তুটির কাছাকাছি পাঠানো হবে ইয়ুতু-২। বর্তমানে রোবটযানটি যেখানে আছে, সেখান থেকে বস্তুটির দূরত্ব ২৬০ ফুটের মতো। তবে দুই থেকে তিন মাসের আগে সেটুকু দূরত্ব পেরোবে না রোবটযানটি।
২০১৮ সালে চাঁদের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিল ইউতু ২ রোভার। ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি প্রথমবার চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ভন কারমার ক্রেটারে অবতরণ (সফট ল্যান্ডিং) করেছিল। যে রোভার তিন মাস কাজ করবে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল। তবে সেই সীমা ইতিমধ্যে পার করে গিয়েছে এবং চাঁদের সবথেকে বেশিদিন ধরে কাজ চালিয়ে যাওয়া রোভারের তকমা পেয়েছে। যে রোভারের সর্বোচ্চ বেগ ঘণ্টায় ২০০ মিটার।
চাঁদ নিয়ে রহস্যের অন্ত নেই। প্রাচীনকালে মানুষ মনে করত, চাঁদ প্রত্যেক রাত্রি মরে ছায়ার জগতে চলে যায়। অন্যান্য সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করত যে চাঁদ সূর্যকে পিছু করছে। পিথাগোরাসের সময়ে, চাঁদকে একটি গ্রহ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মধ্যযুগে কিছু মানুষ বিশ্বাস করত যে চাঁদ হয়তো একটি নির্ভুলভাবে মসৃণ গোলক যা অ্যারিস্টটলের তত্ত্ব সমর্থন করত এবং অন্যান্যরা মনে করত সেখানে সাগর আছে (সাগর বলতে চাঁদের উপরিতলের অন্ধকার অঞ্চলকে বোঝায় যা চিত্র শব্দতে এখনও ব্যবহার করে)।
১৬০৯ সালে গ্যালিলিও যখন তার দূরবীক্ষণ চাঁদের দিকে ধরলেন, তিনি দেখলেন যে চাঁদের উপরিতল মসৃণ ছিল না। তা ক্ষুদ্র কালো রেখা, উপত্যকা, পর্বত এবং খাদের গঠিত হয়। সেই মুহূর্ত থেকে তিনি অনুভব করতে শুরু করেন যে এটি পৃথিবীর মতোই একটি কঠিন গলিত পদার্থ ছিল যা পরে এই রূপ নেয়।
১৯২০ সালেও মনে করত যে চাঁদের শ্বাস গ্রহণের উপযোগী বায়ুমণ্ডল আছে (অথবা ঐ সময় বিজ্ঞানের কাল্পনিক বানোয়াট গল্প বলত) এবং কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটি ক্ষুদ্র বায়ু স্তরের উপস্থিতি আছে বলে অনুমান করত কারণ চাঁদ পর্যবেক্ষণ সময় তারা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু উড়ন্ত বস্তু দেখে ছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৬
আপনার মতামত জানানঃ