কেন্দ্র দখল, ব্যালটে সিলমারা, ককটেল বিস্ফোরণ, দফায় দফায় সংঘর্ষ, টেঁটাযুদ্ধ, গুলি ও মারামারির মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সচেতন নাগরিক সমাজ। আবার অনেকে ভোট দিতে না পারার ক্ষোভও জানিয়েছেন। কেউ কেউ এমন তামাশার নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কিছু প্রার্থী নিজের কিংবা নিজের পরিবারের ভোটও না পাওয়ার বিরল ঘটনায় হতভম্ব হয়ে আছেন। এর মধ্যেই নির্বাচনকে উৎসবমুখর বলেছেন ইসি সচিব। রক্তপাত আর কারচুপির নির্বাচনের পরম্পরার এই ইউপি নির্বাচন তাই আর একটি পালক মাত্র।
সহিংসতার নির্বাচন
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কথিত কড়া মনিটরিং ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থানেও চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সংঘাত-সংঘর্ষ এড়ানো যাচ্ছে না। প্রথম দুই ধাপের মতো তৃতীয় ধাপেও থামানো যায়নি রক্তপাত। আগের তুলনায় সহিংসতা আরো বেড়েছে। জাল ভোট, কেন্দ্র দখল ও গোলাগুলিসহ ব্যাপক সহিংসতায় রবিবার তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে বিজিবিসহ ঝরে গেছে আরো ৯ প্রাণ।
এ নিয়ে এবারের ইউপি নির্বাচনে অন্তত ৬০ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন সহস্রাধিক ব্যক্তি। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের পর শান্তিপূর্ণ ভোট ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ সারাদেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালালেও সুফল মেলেনি। এ নিয়ে ইসি ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর মহলকেও ভাবিয়ে তুলেছে। এমনকি খোদ সরকারী দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা উদ্ধিগ্ন, বিব্রতও।
রবিবার অনুষ্ঠিত তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতায় বিজিবি সদস্যসহ অন্তত ৯ জন নিহত হন। এর মধ্যে ভোটের আগের রাতে আধিপত্য বিস্তার ও কেন্দ্র দখলের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হয়েছেন ২ জন। ভোটের দিন বিকালে ও রাতে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের সময় সংঘর্ষ ও গুলিতে প্রাণ গেছে আরো ৭ জনের।
এর মধ্যে নরসিংদীর রায়পুরায় ৩ জন, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে ৩ জন, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে বিজিবি সদস্য, লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে ১ জন রয়েছেন। এ ছাড়া ভোটের আগের রাতে সহিংসতায় খুলনার তেরখাদায় ১ জন ও যশোরের শার্শায় ১ জন মারা যান। ভোট নিয়ে এই হানাহানিতে দেশের বিভিন্নস্থানে অন্তত দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।
বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার খবরও মিলছে। গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ, জাল ভোট, কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাইসহ নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে তৃতীয় ধাপে ৯৮৬ ইউনিয়ন পরিষদ ও নয়টি পৌরসভায় রবিবার ভোটগ্রহণ হয়েছে। অথচ তৃতীয় ধাপের এই ইউপি নির্বাচনকে সহিংসতাহীন নির্বাচনের মডেল হিসেবে দাবি করেছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার। রবিবার বিকালে এ দাবি করে তিনি বলেন, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এবারের ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণ হয়েছে। ভোটাররাও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক সহিংসতায় সারাদেশে এ পর্যন্ত অন্তত ৬০ জন ব্যক্তির প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন সাতজন ও প্রথম ধাপের নির্বাচনের দিন প্রতিপক্ষের হামলায় ৬ জন প্রাণ হারান। তৃতীয় ধাপেও প্রাণহানি এড়ানো যায়নি। এই ধাপে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
এদিকে, অন্য এক সূত্র মতে, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও পৌরসভায় নির্বাচনী সহিংসতায় এক মাসে ৪৭ জন নিহত হয়েছেন। নভেম্বর মাসে ৯৮টি নির্বাচনী সহিংসতায় এই ৪৭ জন নিহত হয়েছেন। এই সময়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ৭৮ জন ও আহত হয়েছেন ৫ শতাধিক। নিহত ৪৭ জনের মধ্যে ১৬ জন প্রতিপক্ষের গুলিতে এবং চারজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। এদের প্রায় সবাই ভোটে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের সমর্থক-কর্মী।
প্রার্থীর নিজের ভোট গেল কোথায়?
তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার একটি ইউনিয়নে এই বিরল ঘটনা ঘটেছে। সাধারণ সদস্য পদে সাতজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও ভোট পেয়েছেন কেবল একজন প্রার্থী। বাকি ছয় প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট শূন্য।
এর ফলে প্রশ্ন উঠেছে প্রতিদ্বন্দ্বী ছয় প্রার্থীর নিজের ভোট গেল কোথায়? তাদের পরিবার ও সমর্থকরাও কি তাদেরকে ভোট দেননি! তবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের একজনের দাবি, তিনি নিজের প্রতীকে ভোট দিয়েছেন। যদিও ওই ভোট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৮ নভেম্বর বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই ইউনিয়নে ৪নং ওয়ার্ডে সাধারণ সদস্য পদে সাতজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরা হলেন কাউসার মিয়া (ভ্যানগাড়ি), মোতালিব মিয়া (ঘুড়ি), মো. আলমগীর (আপেল), জাহাঙ্গীর হোসেন (তালা), মিস্টার আলী (ফুটবল), সফিকুল ইসলাম (মোরগ) ও হাসান মিয়া (বৈদ্যুতিক পাখা)।
৪ নম্বর ওয়ার্ডের মায়ারামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের মোট ভোটার সংখ্যা দুই হাজার ১৬৩। এ কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন এক হাজার ১৬১ জন ভোটার। এর মধ্যে বৈধ ভোট দেখানো হয়েছে এক হাজার ১৫৫টি। আর বাতিলকৃত ভোট সংখ্যা ছয়টি। তবে বৈধ এক হাজার ১৫৫টি ভোটের সবকটিই হাসান মিয়ার বৈদ্যুতিক পাখা প্রতীকে পড়েছে বলে প্রিসাইডিং অফিসার স্বাক্ষরিত ফলাফল শিটে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভোট না পাওয়া ছয় প্রার্থীর একজন মোরগ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সফিকুল ইসলাম জানান, তিনি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের প্রতীকেই নিজের ভোট দিয়েছেন। কিন্তু কেন তার প্রাপ্ত ভোট শূন্য উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি তার বোধগম্য হচ্ছে না।
আরেক প্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ভোটের দুইদিন আগে স্থানীয় নেতারা এসে এক প্রার্থীকে নির্বাচন করার কথা জানিয়ে তাকে নির্বাচন থেকে সরে যেতে বলেন। সেজন্য ক্ষোভে তিনি কেন্দ্রে যাননি।
নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া প্রার্থী হাসান মিয়া বলেন, ‘”অন্য প্রার্থীরা আমাকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। গ্রামবাসীও আমাকে সমর্থন দিয়েছেন।”
মায়ারামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্বে থাকা হুসাইন মোহাম্মদ বেলাল বলেন, “ভোটের আগেরদিন শুনেছি সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে একজনকে সমর্থন দিয়ে অন্য প্রার্থীরা সরে দাঁড়িয়েছেন। আমার কেন্দ্রে ভোটগ্রহণে কোনো ধরনের সমস্য হয়নি। আমার কাছে কেউ কোনো অভিযোগও করেনি।”
এদিকে, রোববার (২৮ নভেম্বর) ভোট শুরু হওয়ার ৩ ঘণ্টা পর উপজেলার গোলাবাড়ি ইউনিয়নে আনারস প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মজির রহমান ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। মজিবর রহমান বলেন, গোলাবাড়ি ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের হাসনই কেন্দ্রে আমার এজেন্টদের বের করে দিয়ে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মারছে। শুধু তাই নয়, ১০টি কেন্দ্রেই একই অবস্থা। সেখানে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এছাড়া রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মিজানুর রহমান। দুটি ওয়ার্ডে ইভিএম জালিয়াতি হয় বলেও অভিযোগ তার। তিনি জানান, গত ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফা ইউপি নির্বাচনে তিনি কায়েতপাড়া ইউনিয়ন থেকে আনারস প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছেন। সেখানকার ৫৩ হাজার ভোটারের মধ্যে ৯ নং ওয়ার্ডে ভোটার ২২ হাজার। এ ওয়ার্ডটি বহিরাগত সন্ত্রাসীরা কব্জায় রাখে। সেখানে তাকে কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা করতে দেওয়া হয়নি। অথচ ওই ওয়ার্ডে সর্বাধিক ভোটার তাকেই প্রার্থী হিসেবে চেয়েছেন। নির্বাচনের দিন ওয়ার্ডের আটটি কেন্দ্রের কোথাও তার কোনো এজেন্ট দিতে দেওয়া হয়নি।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৪৫
আপনার মতামত জানানঃ