করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন গত ২৪ নভেম্বর শনাক্ত হয় সাউথ আফ্রিকায়। দ্রুত এটি ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, বতসোয়ানা, হংকং ও ইসরায়েলসহ বিশ্বের অনেক দেশে। করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন নিয়ে দুনিয়াজুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে এই ধরনকে ‘উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে বিশ্বকে এটি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
কিন্তু কী কারণে মহামারির দ্বিতীয় বছরের এই সময়ে উদ্ভব হলো ভাইরাসের এই নতুন রূপান্তরিত ধরনটির? বিবর্তনের সাধারণ নিয়মেই কি আগমন ঘটেছে ওমিক্রনের নাকি বিশ্বজুড়ে টিকা বিতরণের বৈষম্যই এজন্য দায়ী? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপি।
ফ্রান্সের কোভিড-১৯ মহামারি টাস্কফোর্সের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ওমিক্রন ধরনটি বিশ্লেষণ করে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, প্রথমবার এই ধরনটির জন্ম ও বিকাশ এমন কোনো রোগীর দেহে ঘটেছে, যিনি দীর্ঘদিন ধরে কোভিডে ভুগেছেন এবং শরীরে করোনা প্রতিরোধী শক্তি বা অ্যান্টিবডির উপস্থিতি কম ছিল।
ফরাসি জীববিজ্ঞান, অণুজীববিদ্যা, রোগতত্ত্ব ও টিকা গবেষণাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান পাস্তুর ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য ও মহামারি বিশেষজ্ঞ আর্নাউড ফনটানেট বলেন, ‘বিজ্ঞানের ভাষ্য অনুযায়ী, যেসব এলাকায় টিকাদান কম হয়েছে, সেসব অঞ্চল ভাইরাসের নতুন প্রজাতি বা ধরনের আগমনের জন্য অনেক বেশি উপযোগী।’
‘আমার বিশ্বাস, বৈশ্বিকভাবে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনার গুরুত্ব এবার উপলব্ধি করতে পারবে উন্নত দেশগুলো এবং স্বীকার করতে বাধ্য হবে—এই গ্রহ তখনই বিপদমুক্ত হবে, যখন আমরা বৈশ্বিক ইমিউনিটি অর্জন করতে পারব।’
বিশ্বের দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে টিকা সহায়তা প্রদানের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক টিকা বিতরণ জোট গ্যাভি ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স ২০২০ সালে ‘কোভ্যাক্স’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ১৪৪টি দেশে এই প্রকল্পের আওতায় ৫০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করা হয়েছে।
তবে সোমবার আফ্রিকান ভ্যাকসিন অ্যাকুইজিশন ট্রাস্ট, আফ্রিকা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন এবং কোভ্যাক্সের এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, টিকা বিতরণের ব্যাপারটি আরও সুশৃঙ্খলভাবে হওয়া প্রয়োজন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশেই স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভঙ্গুর। প্রয়োজনীয়সংখ্যক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যাপক অভাব রয়েছে এসব দেশে।
‘এ কারণে তাৎক্ষণিকভাবে টিকার চালান এলে এই দেশগুলো সমস্যায় পড়ে। টিকাদানের ব্যাপারে প্রচারের জন্য তারা যথেষ্ট সময় পায় না এবং বেশিরভাগ দেশের টিকা সংরক্ষণের মতো অবকাঠামোগত সুযোগও নেই।’
বিষয়টি স্বীকার করেছেন আর্নাউড ফনটানেটও। তিনি বলেন, ‘অনুন্নত দেশগুলোকে টিকা সহায়তা দেওয়ার অর্থ কেবল টিকার ডোজ প্রদান করা নয়, বরং সেসব দেশের লোকজনের টিকার ডোজ গ্রহণের জন্য যা যা প্রয়োজন, সেগুলো সরবরাহ করাও টিকা সহায়তার অন্তর্ভুক্ত।’
করোনাকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণার পরপর টিকা পেতে উঠেপড়ে লাগে কয়েকটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই অধিকাংশ টিকা নিজের দেশের জন্য অগ্রিম কিনে নেয়ার চেষ্টা করেন। এরপর ব্রিটেন, ইতালি, স্পেন, ব্রাজিলও একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়। ধনী কতগুলো দেশ নিজেদের লোকজনের কথা ভেবে টিকা সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় উন্নীত হতে চায়, অন্যদিকে স্বাভাবিক টিকাদান থেকেও পিছিয়ে যায় স্বল্পোন্নত দেশগুলো। ধনী দেশগুলো দ্রুত টিকাদান কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পারলেও পিছিয়ে আছে স্বল্পোন্নত দেশগুলো। দরিদ্র দেশগুলোতে ধীর গতিতে টিকা সরবরাহের অর্থ করোনা মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হওয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছিল, করোনা মহামারি ২০২২ সালেও থাকতে পারে। করোনা মহামারি দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কার পেছনে দরিদ্র দেশগুলোর প্রয়োজনীয়সংখ্যক টিকা না পাওয়ার বিষয়টি সামনে এনেছে ডব্লিউএইচও।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘মহামারির এ বিশ্বে আমরা কেউই নিরাপদ নই, যতক্ষণ না প্রত্যেকেই নিরাপদ হই। আমরা কেউই দৌড়ে জিতব না, যতক্ষণ না প্রত্যেকেই জিতব’। বিশ্ব টিকা জোগান দাতা ‘কোভ্যাক্সে’র এই স্লোগান টিকা বৈষম্যহীন বিশ্ব গড়ার এক অনন্য স্বপ্নছোঁয়া স্লোগান। কথা ছিল সবার জন্য টিকা, এখন কতকের জন্য টিকা আর কতকের জন্য টিকা ভিক্ষা। বিশ্বব্যাপী টিকা বৈষম্যের এ দুর্দশা দেখে মনে পড়ছে আরেকটি অগ্নিঝরা স্লোগান। আর তা হলো ‘টিকা বৈষম্যের এ আগুন, ছড়াবে বহুগুণ সবখানে’। একসময় ছিল টিকা অসচেতনতায় ভরা বিশ্ব ইতিহাস, যার জন্য দায়ী করা হতো বিশ্ব জনতাকে; আর এখন রচিত হতে যাচ্ছে টিকা বৈষম্যে ভরা আরেকটি নতুন ইতিহাস, যার জন্য দায়ী করতে হবে পশ্চিমা বিশ্বকে। টিকাকরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাপী একসাথে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ গড়ে তোলা, ঝুঁকিযুক্ত দুর্বলদের ঝুঁকিমুক্ত করা। আর এখন হবে শুধু সবলরা ঝুঁকিমুক্ত আর দুর্বল-অবলারা হবে আরো ঝুঁকিযুক্ত, আরো দুর্বল।
বিজ্ঞানের ভাষ্য অনুযায়ী, যেসব এলাকায় টিকাদান কম হয়েছে, সেসব অঞ্চল ভাইরাসের নতুন প্রজাতি বা ধরনের আগমনের জন্য অনেক বেশি উপযোগী।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়াসুস যথার্থই বলেছেন, বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিনের বৈষম্য এ মহামারিটি শেষ করতে এবং কোভিড-১৯ থেকে পুনরুদ্ধারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাধা। জীবন রক্ষাকারী এই ভ্যাকসিনকে সার্বজনীন করতে সব শক্তি সর্বোত্তম উপায়ে বিনিয়োগ করা এখন বিশ্ববাসীর সবচেয়ে অগ্রাধিকারযোগ্য কাজ। টিকা নীতিতে ‘কলঙ্কজনক বৈষম্য’ বিরাজ করায় মহামারিটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। টিকাগুলো ন্যায়সঙ্গতভাবে বিতরণের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী ব্যর্থতা এ মহামারিকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলছে, যা এখন বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এবং সবচেয়ে দুর্বল দেশ ও ব্যক্তিদের ওপর প্রভাব ফেলছে। বৈষম্যের বড় শিকার আফ্রিকা মহাদেশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১৯ সালে বিশ্বে স্বাস্থ্যের জন্য ১০টি চরম হুমকির মধ্যে অন্যতম ছিল টিকা অসচেতনতা। আফ্রিকা মহাদেশের কিছু দেশে অন্যান্য রোগের পাশাপাশি টিকা অসচেতনতাও আরেকটি রোগ। কিন্তু অন্য দেশগুলোতে টিকা অসচেতনতায় ভরা টিকার ইতিহাস যখন টিকা সচেতনতায় রূপ নিচ্ছে, তখন আবার টিকা বণ্টন বৈষম্যের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করছে উন্নত বিশ্ব। একসময়ে দীর্ঘ সময়ব্যাপী ভাগাভাগি করে আফ্রিকা শাসন করেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। এখন তারা টিকা-শাসন শুরু করেছে আফ্রিকায়।
আফ্রিকায় ভ্যাকসিনের অসম বণ্টন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধান বলেছেন, আফ্রিকায় এই অসম বণ্টন শুধু আফ্রিকাবাসীকেই নয়, বরং আমাদের সবাইকেই মর্মাহত করেছে। এই অসম বণ্টন যত দিন থাকবে, করোনাভাইরাসের মিউটেশন-ভ্যারিয়েন্ট গঠনের সুযোগ তত দিন থাকবে। এভাবে যত ভ্যারিয়েন্টের জন্ম দেবে, তত ভ্যাকসিনের সব সফলতাকে ভণ্ডুল করে দেবে।
আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়া টিকা অসচেতনতার রাহুগ্রাস থেকে অনেকটা মুক্তি পেলেও আফ্রিকার অনেক দেশ এ ব্যাপারে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। তুলনামূলকভাবে দরিদ্র এ মহাদেশের অন্তত ২৪টি দেশ লক্ষ্য অনুযায়ী টিকা দিতে পারেনি অসচেতনতার কারণে। এর বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটছে জনসাধারণের অজ্ঞতা ও টিকাভীতি থেকে।
রিপাবলিক অব কঙ্গো ও আইভোরিকোস্ট কোভ্যাক্স থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার যথাক্রমে ১৭ লাখ ডোজ ও পাঁচ লাখ চার হাজার ডোজ করোনার টিকা পেয়েছিল। কঙ্গো টিকা দেয়া শুরু করেছে মাত্র গত এপ্রিল, ২০২১তে। দেশটিতে দুই হাজারেও কম মানুষ টিকা নিয়েছেন। এ কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ব্যবহার না হওয়া টিকা প্রতিবেশীদের দিয়ে দিতে হতে পারে।
আইভোরিকোস্টেও একই অবস্থা। ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র এক লাখ ৫৫ হাজার ডোজের মতো টিকা। কারণ মানুষের মধ্যে করোনার টিকা নেয়ার আগ্রহ খুব কম। যাদের টিকা অসচেতনতার ঘোর কেটে গেছে, তাদের আবার ‘টিকা নেই’ সমস্যা।
বাংলাদেশ, ঘানা ও উত্তর আফ্রিকার বেশ কিছু দেশসহ বিভিন্ন দেশের অনেক টিকা সচেতন মানুষ সময়মতো টিকার দ্বিতীয় ডোজ পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরুর দিকেও অসচেতনতার মনোভাব অব্যাহত ছিল বাংলাদেশে। তখন টিকা ছিল কিন্তু টিকা নেয়ার লোক ছিল না। এখন টিকা নেয়ার লোক আছে; কিন্তু টিকা নেই। এ অবস্থা বিশ্বের নিম্ন আয়ের দেশে দেশে, যেন ‘টিকার দুর্ভিক্ষ’।
অন্য দিকে ধনী দেশগুলোর সমস্যা টিকার মজুদ আর কুটিলতা। হাতে টিকার উদ্বৃত্ত রয়েছে। সময়মতো ব্যবহার না হলে মজুদ করা টিকার মেয়াদ পেরিয়ে যেতে পারে। তবুও টিকা হাতে রাখা চাই। ধনী দেশগুলোর মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা, বাড়াতে টিকার মজুদ-উদ্বৃত্ত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে এখন পৃথিবীতে একটি নতুন ধরনের জাতীয়তাবাদ জন্ম নিয়েছে— ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’। যেখানে ধনী দেশেরা লাভবান হচ্ছে। কিন্তু যদি পৃথিবীর সব দেশে টিকাকরণ প্রক্রিয়া ঠিকমতো না হয় তাহলে এই মহামারি আরও অনেক বছর প্রলম্বিত হতে পারে। বিশ্বনেতৃত্বের এখন সময় এসেছে টিকা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যপ্রযুক্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্যের জগতে সবার সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করার, যা অবশ্যই সবার কাছে সুলভ হবে এবং সবার কাছে পৌঁছাবে। যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বা ‘ক্রিটিক্যাল মাস’-এর কাছে টিকা পৌঁছানোর এই কাজটি সফলভাবে করা যায় তাহলে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের শরীরে কৃত্রিমভাবে ইমিউনিটি তৈরি করা যাবে, যেমনটা স্মল পক্স বা পোলিওর ক্ষেত্রে হয়েছে। এর পরিণতিতে এই রোগটির বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি বা গোষ্ঠী অনাক্রমণ্যতা গড়ে উঠবে এবং রোগটি আপাতত নিস্তেজ অবস্থায় চলে যাবে (যদিও এর জ্ঞাতি-গোষ্ঠীরা আবার সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে কখন পরিস্থিতি বুঝে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধা যায়)।
তারা বলেন, এ কথা ঠিক যে, করোনার টিকা সবার জন্য সহজলভ্য করার কাজটি রাতারাতি হবে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে যাদের সামর্থ্য আছে তারাই শুধু এই টিকা পাবে। এজন্য উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে মনে রাখতে হবে যে, যেসব জায়গায় এই টিকা সবচেয়ে বেশি দরকার, সেখানে যদি এটা না দেওয়া যায়, তাহলে এই মহামারি চলতেই থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত তারাও নিরাপদ থাকবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ