বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত প্রায় ১১ লাখ উদ্বাস্তুর উপস্থিতি প্রায় চার বছরে গড়িয়েছে। শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্মের কারণে এ সংখ্যা এত দিনে আরও বেড়েছে। অথচ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য বাংলাদেশ সরকার যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করেছিল, তাতে তেমন অগ্রগতি তো হয়নি; বরং এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কথিত গণতান্ত্রিক ও বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করার পর এ প্রক্রিয়া খাদে পড়েছে। এককথায় বাংলাদেশের সামনে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আপাতত কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়া দৃশ্যমান আর কোনো পথ খোলা নেই। তবে এক্ষেত্রে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন এবং ভারত।
সম্প্রতি জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ পরিষদে তৃতীয় কমিটিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ১০৭টি দেশের অভিন্ন মতে প্রস্তাব পাস হয়েছে। প্রস্তাবে মিয়ানমার সরকারকে অবিলম্বে বাস্তুচ্যুত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শুধু রোহিঙ্গা নয়, মিয়ানমারের আরও অনেক জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের দেশছাড়া করা হয়েছে তাদেরও ফেরত আনা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অত্যাচার যেন না হয়, তার নিশ্চয়তা চাওয়া হয়।
এ প্রস্তাবের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর যৌথ উদ্যোগে এটা সম্ভব হয়েছে। ১০৭টি দেশ একসঙ্গে এ প্রস্তাব উত্থাপন করে, যার মধ্যে ওই দুটি জোটের সদস্য ছাড়াও যোগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো দেশ। এ প্রস্তাবের বিপক্ষে কোনো দেশ ভোট দেয়নি। তবে আসিয়ানভুক্ত কয়েকটি দেশসহ ভারত এবং চীন অনুপস্থিত ছিল। যা ব্যহত করছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো জাপানের যোগদান। কারণ জাপান মিয়ানমারে অন্যতম প্রধান অর্থলগ্নিকারী দেশ এবং এ পর্যন্ত মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দেয়নি। এককথায় সামরিক সরকারের সঙ্গে যোগসূত্র বজায় রেখে চলেছে। তথাপি জাপান এ প্রস্তাবের একজন সমর্থক হিসেবে নাম লিখিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ওপর এ প্রস্তাবের কী প্রভাব পড়তে পারে বা আদৌ পড়বে কি না। অতীতের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, জাতিসংঘের এসব প্রস্তাব বিশ্বে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিশেষ করে যেসব দেশের পেছনে বড় কোনো দেশ বা ভূরাজনৈতিক শক্তি রয়েছে। ইসরায়েল এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। ইসরায়েল এ পর্যন্ত জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাবকে ধর্তব্যেই নেয়নি।
মিয়ানমার ইসরায়েলের মতো শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র না হলেও আয়তনের দিক থেকে পূর্ব এশিয়ায় বৃহত্তম, সম্পদশালী এবং বর্তমান বিশ্বরাজনীতির বিবেচনায় ভূরাজনৈতিকভাবে এ অঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। দেশটি একদিকে চীনের বিআরআই প্রকল্পের পূর্ব খুঁটি এবং বিশাল লগ্নির স্থান। এমনকি ভারতের জন্যও ভূরাজনৈতিকভাবে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ। এসব শক্তির বলে বলীয়ান মিয়ানমার তাই তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৭ নভেম্বর ২০২১ বলেছে এ ধরনের প্রস্তাব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, পক্ষপাতে দুষ্ট এবং বাস্তবতা বিবর্জিত।
মূলত মিয়ানমার সামরিক সরকার এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে চীন, জাপান, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশসহ আরও অনেক দেশ তাদের পক্ষেই রয়েছে। মাত্র কয়েক মাস আগেই চীন অর্থনৈতিক করিডর এবং অন্যান্য চুক্তি যার মধ্যে গ্যাস ও জ্বালানি তেল ও যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য প্রায় ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। তা ছাড়া অন্যান্য খাতেও চীনের তহবিল উন্মুক্ত রয়েছে। মিয়ানমারের কোথাও কোথাও সামরিক শাসনের পক্ষে দাঁড়ানোয় চীনের বিনিয়োগ করা প্রকল্পে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। তাই রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের টানই টানবে চীন।
বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে সৃষ্ট নতুন ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের কারণে চীনও মিয়ানমারের ওপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়াচ্ছে। আর মিয়ানমারের শাসকেরা এ সুবিধাকেই ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছেন। বিশ্বে প্রভাব বিস্তারে চীনের বিআরআই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ ধরা হয় মিয়ানমারকে। এটা হচ্ছে, ভারত মহাসাগরে চীনের প্রবেশদ্বার। এর বিনিময়ে মিয়ানমার যা চেয়েছে, তা-ই দিয়েছে চীন।
চীনের নতুন ভূ-কৌশলগত পরিকল্পনা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআইয়ের যাত্রা শুরুর পর থেকে মিয়ানমারের বঙ্গোপসাগরতীরের রাখাইন (আরাকান) অঞ্চল বিশ্বের অন্যতম কৌশলগত ভূমিতে পরিণত হয়েছে। রাখাইন-ইউনান গ্যাস পাইপলাইন ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা তেল পরিবহনের জন্য পাইপলাইন আছে একই পথে। আছে চীনের তৈরি গভীর সমুদ্রবন্দর এবং নির্মাণাধীন রেল ও সড়ক সংযোগ। আফ্রিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যে এ পথের গুরুত্ব দিন দিন বাড়বে। বলা হচ্ছে, চীনা অর্থনীতির লাইফলাইন হয়ে উঠতে পারে এই প্রবেশদ্বার। এসবের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগরে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির ভারসাম্য চীনের পক্ষে রাখা হবে।
এর আগে রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের (আইসিজে) ঐতিহাসিক আদেশ নিয়ে প্রতিক্রিয়াহীন ছিল ভারত ও চীন। বিশেষ করে ভারতের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না থাকার বিষয়টি সবচেয়ে হতাশাজনক বলে বাংলাদেশের একাধিক কূটনৈতিক সূত্র জানায়। সে সময় বিশেষজ্ঞরা বলেছিল, ভারত কখনই রোহিঙ্গা ইস্যুতে সক্রিয় অবস্থানে ছিল না। দেশটি সব সময়ই কৌশলগত অবস্থানে থেকেছে এবং এ রায়ের ক্ষেত্রেও কৌশলগত অবস্থানে থেকেই প্রতিক্রিয়াহীন রয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের মতো বন্ধুদেশকেও কখনও পাশে পায়নি বাংলাদেশ।
চীন ও ভারত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুটি দেশই কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, সীমান্ত নিয়ে চীনের সাথে ভারতের বিরোধ দীর্ঘদিনের। দেশ দুইটি বেশ কয়েকবার যুদ্ধেও জড়িয়েছে। ভারতের আকসাই চিন অঞ্চল ও অরুণাচল প্রদেশকে চীন নিজেদের এলাকা মনে করে। সেকারণে দেশটি লাদাখ ও সেভেন সিস্টার্স নিয়ে চরম নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে। এ ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে থাকা শিলিগুড়ি করিডোর। এ করিডোরটি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সেভেন সিস্টার্সে যোগাযোগের একমাত্র পথ। চীনের দোকলাম থেকে যার দূরত্ব মাত্র ১৩০ কিলোমিটার। দুর্যোগপূর্ণ সময়ে চীনের চুম্বী ভ্যালিতে মোতায়েন থাকা সেনাবাহিনী শিলিগুড়ি করিডোরের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে পুরো সেভেন সিস্টার্স ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ফলে নিরাপত্তা ও যোগাযোগের কথা চিন্তা করে ভারত কালাদান প্রকল্পের মাধ্যমে সেভেন সিস্টার্সে প্রবেশের বিকল্প একটি পথ তৈরিতে উদ্যোগী হয়। ভারতের কলকাতা থেকে সমুদ্রপথে মিয়ানমারের সিটওয়ে বন্দর হয়ে কালাদান নদীপথে পালেতোয়া। সেখান থেকে সড়কপথে ভারতের মিজোরাম তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করা যাবে। সংক্ষেপে এই হল কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্টের রুট। এটার ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে দ্রুত সংযোগ স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ রুট ছাড়াও অন্য একটি বিকল্পও তৈরি থাকলো ভারতের কাছে। এ কারণে ভারতের কাছে দেশটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
জাতিসংঘের এ প্রস্তাবকে বাংলাদেশের জন্য কিছুটা কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে বিবেচনা করা গেলেও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তা কোনো প্রভাব ফেলবে না। আর এর কারণ মিয়ানমারের ঢাল হয়ে দাঁড়ানো ভারত এবং চীনের অবস্থান।
এসডব্লিউ/এসএস/১২০৫
আপনার মতামত জানানঃ