খারাপ অর্থনীতির সম্মুখীন পাকিস্তান খাদ্যাভাবের সংকটের পাশাপাশি বেকারত্বের চরম সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদের কারখানা চালানো পাকিস্তানের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে যে, গত অর্থবছরে আদায় করা প্রতি ১০০ রুপি রাজস্বের মধ্যে ৮৫ রুপিই বিদেশি ঋণ পরিশোধে খরচ করেছে পাকিস্তান। অর্থাৎ দেশটির প্রতিরক্ষা, উন্নয়ন, ভর্তুকি, সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা, পেনশন সব অর্থই মেটানো হয়েছে বিদেশি ঋণ নিয়ে।
নতুন পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান খান। তবে ইমরানের নেতৃত্বে পাকিস্তান নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে। সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য পরিচিত পাকিস্তানকে এই অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে বাইরে থেকে ৫১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন।
শনিবার (২৭ নভেম্বর) পাকিস্তানি দৈনিক দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে পাকিস্তান প্রতি ১০০ রুপি রাজস্বে ৮৫ রুপি ব্যয় করেছে দেনা মেটাতে। সেখানে ভারতের ব্যয় হয়েছে ১০০তে ৫১ রুপি, আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ২০’র কাছাকাছি মাত্র।
চলতি অর্থবছরে পাকিস্তানের দশা আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশটির খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ড. আশফাক হাসান খান।
দ্য নিউজের খবর অনুসারে, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ড (এফবিআর) ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৪০০ কোটি রুপি রাজস্ব আদায় করে। জাতীয় অর্থ কমিশন (এনএফসি) পুরস্কারের অধীনে প্রদেশগুলোকে ২ লাখ ৭৪ হাজার ১০০ কোটি রুপি দেওয়ার পর সংস্থাটির হাতে থাকে ২ লাখ ২ হাজার ৩০০ কোটি রুপি।
একই সময়ে ট্যাক্স বহির্ভূত রাজস্ব আসে ১ লাখ ৪৮ হাজার কোটি রুপি। এ নিয়ে পাকিস্তান সরকারের হাতে জমা পড়ে মোট ৩ লাখ ৫০ হাজার ৩০০ কোটি রুপি। এই অর্থে সবচেয়ে বড় কামড়টি বসিয়ে ছিল বিদেশি ঋণের কিস্তি। এই খাতে পাকিস্তানের খরচ হয়েছে পুরো ২ লাখ ৭৪ হাজার ৯০০ কোটি রুপি।
ফলে সবধরনের উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা, বেতন-পেনশন ব্যয় মেটাতে দেশটির হাতে ছিল মাত্র ৭৫ হাজার ৪০০ কোটি রুপি। এতে বাধ্য হয়েই ফের বিদেশি ঋণের দিকে হাত বাড়াতে হয় পাকিস্তান সরকারকে। বাজেটের ঘাটতি পূরণে গত অর্থবছরে দেশটি ৩ লাখ ৪০ হাজার ৩০০ কোটি রুপি ঋণ নিয়েছে, যা তাদের মোট জিডিপির ৭ দশমিক ১ শতাংশের সমান।
২০২০-২১ অর্থবছরে পাকিস্তান প্রতি ১০০ রুপি রাজস্বে ৮৫ রুপি ব্যয় করেছে দেনা মেটাতে। সেখানে ভারতের ব্যয় হয়েছে ১০০তে ৫১ রুপি, আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ২০’র কাছাকাছি মাত্র।
স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের দেয়া তথ্যমতে, ২০২১ সালের জুনের শেষে পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক ঋন এবং দেনার স্থিতির পরিমাণ ছিল ১২২.৩ বিলিয়ন ডলারে। যেখানে ২০২০ সালের একই সময়ে দেশটির বৈদেশিক ঋনের স্থিতির পরিমাণ ছিল ১১৩ বিলিয়ন ডলার।
তাছাড়া ২০০৮ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋন এবং দেনার বোঝা অবিশ্বাস্যভাবে ১৫০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়ে যায়। যেখানে দেশটির ২০০৮ সালে বৈদেশিক ঋনের পরিমাণ ছিল ৪৫.৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থ বছরে পাকিস্তানের ইমরান সরকার নতুন করে আরও ১৬.০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি বৈদেশিক ঋন প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। যা তারা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফএ সহ চীন ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর কাছ থেকে নিতে পারবে বলে আশাবাদী।
পাকিস্তানের ইমরান সরকার ২০২১-২২ অর্থ বছরের নতুন বাজেটে মোট ৩,০৬০ বিলিয়ন রুপী কিংবা ১৯.৪৮ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রেখেছে শুধুমাত্র দেশটির অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋন ও দেনা পরিশোধ করার জন্য। সে হিসেবে তাদের মোট বাজেটের একটি বড় অংশ বা ৩৬.০৯% পর্যন্ত সরাসরি ব্যয় হয়ে যাবে শুধুমাত্র ঋণের আসল ও সুদ বাবদ পরিশোধ করতে। এতে করে দেশটির সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার উপর মারাত্মক চাপ পড়তে বাধ্য। যার ফলে দেশটির শিল্পায়ন, দরিদ্র বিমোচন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নমুলক কর্মকাণ্ড চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যেতে পারে।
পাকিস্তান নতুন করে ২০২১-২২ অর্থ বছরে যে বৈদেশিক ঋন নিবে তার ৬০% পর্যন্ত সরাসরি ব্যয় করতে হবে আগে থেকে অন্য দেশ এবং সংস্থা থেকে নেয়া বৈদেশিক ঋনের আসল ও সুদ বাবদ পরিশোধ করতে। তার মানে পাকিস্তান বর্তমানে অন্য দেশে থেকে নেয়া পূর্বের ঋণের কিস্তি এবং এর সুদ বাবদ পরিশোধ করতে নতুন করতে আরেক দেশ বা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থা থেকে নির্বিচারে এবং কঠিন শর্তের মুখে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। যা বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক সতর্ক বার্তা দেখা হচ্ছে।
তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান তার চিরবৈরী ভারতের সাথে সামরিক শক্তিতে পাল্লা দিতে গিয়ে আধুনিক ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ক্রয় এবং তার পাশাপাশি অপরিকল্পিত একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পসহ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) প্রকল্পে নির্বিচারে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের কারণে বর্তমানে পাকিস্তানের পাহাড় সমান বৈদেশিক ঋণ ও দেনার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে পাকিস্তানে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ ও দেনার পরিমাণ আনুমানিক ১ লক্ষ ৪৫ হাজার পাকিস্তানী রুপীর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
২০২০-২১ অর্থ বছরে পাকিস্তান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবি থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে। যেখানে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে পাকিস্তান মোট ১০.৫০ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে মোট ৮.৪০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ নিয়েছিল।
স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের তথ্য অনুযায়ী চলতি ২০২১ সালের ৯ই সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১২৩ মিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়ে ২০.০২ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়। তবে প্রকাশ থাকে যে, পাকিস্তানের এই রিজার্ভের ৬০% কিনা আবার বৈদেশিক ঋণ ও আর্থিক সহায়তার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। আর দেশটির বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ ও দেনার বিবেচনায় ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ কিন্তু মোটেও যথেষ্ঠ নয়।
জানা যায়, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের মোট দেনার পরিমাণ ৫০ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন (১ ট্রিলিয়ন=১ লাখ কোটি) রুপি পার হয়েছে। অথচ মাত্র সাড়ে তিন বছর আগেও পিটিআই যখন ক্ষমতায় বসে, তখনো দেশটির মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন রুপি। অর্থাৎ ইমরান খানের শাসনামলে পাকিস্তানের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে অন্তত ২১ ট্রিলিয়ন রুপি, যা দেশটির ইতিহাসে তিন বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ।
পাকিস্তানের সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. হাফিজ এ পাশার মতে, ভারতের ঋণের পরিমাণও ক্রমেই বাড়ছে। তবে তাদের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোর প্রতিবেদনে ভিন্ন পরিস্থিতি ফুটে ওঠে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়াও ভারতীয় রাজ্যগুলো ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ঋণ নিয়েছে। তাই তাদের কেন্দ্রীয় ঋণে পুরো পরিস্থিতি বোঝা যায় না। এক্ষেত্রে পাকিস্তান ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের চাপ অনেক কম বলে উল্লেখ করেছেন এ অর্থনীতিবিদ।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) গত আগস্ট মাসে তার সর্বশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটি বলছে, বর্তমান বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলাফল ব্যাপক অপরিবর্তনীয়। আরও একটি উদ্বেগজনক ফল হলো, মেরু অঞ্চল ও পর্বত হিমবাহগুলো কয়েক দশক বা শতাব্দী ধরে অপরিবর্তনীয়ভাবে গলতে থাকবে। এদিকে মেরু বরফের বাইরে পৃথিবীর যেকোনো জায়গার চেয়ে পাকিস্তানে হিমবাহ বেশি। তাই বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্তিত্ব সংকটের মুখে রয়েছে পাকিস্তান।
মেরু বরফের বাইরে পৃথিবীর যেকোনো জায়গার চেয়ে পাকিস্তানের হিমবাহ বেশি। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত গ্রহের প্রাচীনতম এবং উর্বর উপত্যকা সিন্ধু অববাহিকায় হিমবাহ পাকিস্তানের জীবিকার মাধ্যম। পাকিস্তানের ২১৬ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ সিন্ধু নদীর তীরে বসতি স্থাপন করেছে। এর পাঁচটি বৃহত্তম নগরকেন্দ্র শিল্প ও গৃহস্থলির কাজে ব্যবহৃত পানির জন্য নদীর উপর নির্ভরশীল। পাকিস্তান কৃষিচক্রের আশীর্বাদপুষ্ট যা ধারাবাহিক সংকট মোকাবিলা করে টিকে আছে। তবে, আইপিসিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১০৫
আপনার মতামত জানানঃ