করোনাভাইরাসের পরপরই দাম বৃদ্ধি পেয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসের। এতে বিপাকে পড়েছে বিশ্বের সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। মূলত গ্যাসকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেই নাইট্রোজেন থেকে ইউরিয়া সার উৎপাদন করা হয়। গ্যাসের অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধিতে সার উৎপাদনে ভাটা পড়েছে। এতে পরবর্তীতে খাদ্য উৎপাদনে সংকট দেখা দিতে পারে।
বিশ্বের অনেক দেশে খাদ্যের ঘাটতি রয়েছে। ফসল উৎপাদনের জন্য বিশ্বজুড়ে সারের যেই ঘাটতি দেখা দিয়েছে তাতে খাদ্যের দাম অনেকাংশে বেড়ে যাচ্ছে। ফলে দরিদ্র দেশগুলোকে চরম সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কারণ সার উৎপাদনের জন্য প্রচুর পরিমাণে গ্যাসের প্রয়োজন হয়।
এ বিষয়ে বিবিসি টুডের প্রোগ্রামের সঙ্গে কথা হয় স্ভেইন তোরে হোলসেথারের, যিনি নরওয়ের বৃহৎ রাসায়নিক কারখানা ইয়ারা ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী পদে কর্মরত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গ্যাসের উচ্চমূল্যের কারণে তার কোম্পানি বাধ্য হয়ে কিছু উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। তাতে খাদ্যের দামও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
এই প্রধান নির্বাহী মনে করেন, ঘাটতির ফলে উন্নয়শীল দেশগুলো সবচেয়ে বড় ধাক্কা খাবে। কারণ, ফলন কমে যাওয়া মানে খাদ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ‘এটি সত্যিই ভীতিকর যে আমরা খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হচ্ছি। এতে দরিদ্র লোকেরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে’।
বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, খাদ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দামে বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক লোকের মানিব্যাগের উপর প্রভাব পড়ছে। এটি শুধু মানিব্যাগ নয়, জীবন মৃত্যুর প্রশ্ন’।
কৃষকরা ভুট্টা, ক্যানোলো এবং গমের মতো ফসল উৎপাদনের জন্য সারের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ধীরে ধীরে উৎপাদন কমা মানে কৃষকরা চাহিদা মতো জমিতে ফসল রোপণ করতে পারবেন না। একপর্যায়ে ফসল পুষ্টির অভাবে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলনও পাবে না কৃষকরা।
এই সংকট দেখা দিয়েছে মূলত গত কয়েক মাসে ধাপে বিশ্বজুড়ে গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায়। এর বড় কারণও রয়েছে যেমন, মহামারি করোনার ধাক্কা।
ইয়ারা ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বের যেকোনও কোম্পানির চেয়ে বেশি উৎপাদন করে থাকে। গত বছরের তুলনায় ২৫৫ শতাংশ বেশি উৎপাদন করেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
কিন্তু পরিস্থিতি এখন খুবই অস্থির। বড় পর্যায়ের দুর্ভিক্ষ এড়াতে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি-ডব্লিউএফপি’র সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন তোরে হোলসেথার।
সহায়তার প্রসঙ্গ টানার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, গত বছর পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতে ৪০ হাজার টন সার দান করেছিল সার উৎপাদনকারী কোম্পানি ইয়ারা ইন্টারন্যাশনাল। পরবর্তীতে দেখা গেছে, এই সহায়তার ফলে ছোট ছোট খামারিরা বেশ উপকৃত হয়।
কৃষকরা ভুট্টা, ক্যানোলো এবং গমের মতো ফসল উৎপাদনের জন্য সারের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ধীরে ধীরে উৎপাদন কমা মানে কৃষকরা চাহিদা মতো জমিতে ফসল রোপণ করতে পারবেন না। একপর্যায়ে ফসল পুষ্টির অভাবে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলনও পাবে না কৃষকরা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিএফ জানিয়েছে, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় নাইট্রোজেনভিত্তিক সার মূলত ইউরিয়ার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে খাদ্যপণ্য বিশেষ করে গম, ভুট্টা, সয়াবিন থেকে শুরু করে ফসলি পণ্যে ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
সিএফ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বার্ট ফ্রস্ট বলেন, সার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বিশ্বে খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হতে পারে। আর এভাবে চলতে থাকলে পরবর্তীতে দুর্ভিক্ষের মতো দুর্যোগের মুখোমুখি হতে পারে পুরো বিশ্ব।
রাশিয়ার পাশাপাশি চীনও সার রপ্তানি থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, সার উৎপাদন ব্যাহত হওয়া এবং কৃষকের পণ্য উৎপাদনে খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষ দুর্দশার মুখোমুখি হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
এদিকে বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত মাসে যা ছিল গেল এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, গত বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটে এ বছর দাম সর্বোচ্চে পৌঁছায়।
অক্টোবরে টানা তৃতীয় মাসের মতো এফএও’র খাদ্যমূল্য সূচক ঊর্ধ্বমুখী ছিল। আগের মাসের চেয়ে তিন শতাংশ বেড়ে ২০১১ সালের জুলাইয়ে মূল্যবৃদ্ধি সর্বোচ্চ চূড়ায় গিয়ে ঠেকেছে।
খাদ্যমূল্য বাড়লে তার প্রভাব সবার ওপরে পড়ে। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারগুলোতে সেই প্রভাব খুবই বিরূপ হয়ে ওঠে। কারণ তাদের আয়ের বড় অংশটিকেই পরিবারের খাবারের পেছনে খরচ করতে হচ্ছে।
দেশগুলো করোনার বিধিনিষেধ থেকে ধাপে ধাপে বেরিয়ে আসলেও খাদ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্যের মূল্য চলতি বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনে সরবরাহ ও উৎপাদন সংকটের কথাও বলা হয়েছে।
কিছু কিছু ফসলের সংগ্রহ কমে গেছে। আর জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রবল আকার নিয়েছে। এফএও’র হিসাবে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে খাদ্যশস্য ও ভোজ্য তেলের। অক্টোবরে ভোজ্য তেলের দাম প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সামরিকতন্ত্রী রাষ্ট্র ও যুদ্ধবাজ মানুষের অমানবিক ও সহিংস তাণ্ডবে বিশ্বের বহু দেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিক মৃত্যু ও রক্তপাতে নিপতিত, যারা খাদ্যের সংস্থান করা তো দূরস্থিত, জীবন বাঁচাতেই মরিয়া। রণাঙ্গনে, শরণার্থী শিবিরে, পথে পথে সংঘাতদগ্ধ এইসব বিপুল ভাসমান মানুষের জীবন কাটে অনাহারে, অর্ধাহারে, খাদ্যহীনতায়।
সুষম বণ্টন আর শান্তি বিরাজমান থাকলে বিপুলা এই পৃথিবীর উর্বর ভূমিতটে উৎপাদিত খাদ্যের দ্বারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য অন্ততপক্ষে এক মুঠো ভাত জুটতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু শোষণ, লুণ্ঠন, যুদ্ধ, দখল, রক্তপাতের ফলে তা হচ্ছে না। হিংসা, হানাহানি ও লুটপাটের তাণ্ডবতায় শান্তি, স্থিতি, নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে মানুষের মুখের গ্রাস।
তারা বলেন, খাদ্যের নিরাপত্তার অভাবকে না মিটিয়ে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি অসম্ভব৷ শান্তি ছাড়া বিশ্বজুড়ে ক্ষুধাকে হার মানানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ৷ খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার৷ আজ আমরা এমন একটা সময়ে বাস করি যেখানে প্রতি দিন লাখ লাখ মানুষ এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৫৫
আপনার মতামত জানানঃ