গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বৃদ্ধির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন অঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ ঝুঁকিতে পড়বে। বিশ্বে দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে৷ কিন্তু সে হারে বাড়ছে না খাদ্য উৎপাদন৷ এক্ষেত্রে সবথেকে বেশি ভুক্তভোগী দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহ।
কৃষি খাতটি এখনও দক্ষিণ এশিয়ায় দেশ সমূহের ৫০ শতাংশেরও বেশি জনসংখ্যার জীবিকা ও কর্মসংস্থানের প্রধান উপায়। এদিকে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে এ অঞ্চলে ফসলের উৎপাদন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
যার ফলে এই অঞ্চলে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক সুবিধা বঞ্চিত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য এবং জীবিকা ঝুঁকির মুখে পড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৬০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
দক্ষিণ এশিয়ার কৃষকরা বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বেশি এবং পৃথিবীর কৃষিজমির মাত্র ৫ শতাংশ দিয়ে তাদের কৃষি উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এই অঞ্চলের দেশগুলো কোভিড-১৯ অতিমারির আগেই খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা এবং অনুন্নত জনস্বাস্থ্যসহ একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষ এখনও মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীন এবং এই অঞ্চলে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের ৩৬ শতাংশ অপুষ্টির কারণে হতবুদ্ধির শিকার এবং ১৬ শতাংশ তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। বিশ্বের হতবুদ্ধি শিশুদের প্রায় ৪০ শতাংশ দক্ষিণ এশিয়ায়।
এর মধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী ১০০ বছরে এশিয়া অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিশেষজ্ঞরা৷ বিশেষ করে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ধান উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন যে সমস্যা হচ্ছে তা হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যা, জ্বলোচ্ছাস বা ঘূণিঝড়ের কারণে বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার মানুষ প্রতি বছর সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। সেসব এলাকার মানুষ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে (শহরাঞ্চলে) জড়ো হচ্ছে। সেখানেই তাদের বাসস্থান এবং জীবিকার সন্ধান করছে। ফলে এসব বাড়তি মানুষের চাপ পড়ছে সেই এলাকায়। ব্যাঘাত ঘটছে খাদ্য শৃঙ্খলে।
প্রতি বছরই বন্যার সময় ভাঙনের কারণে বাড়িঘর, জমি-জিরাত সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। এসব মানুষ কাজের সন্ধানে শহরাঞ্চলে আসছে। ফলে গ্রাম ও শহরের মধ্যে জনসংখ্যার ভারসাম্যে ব্যাপক তারতম্য ঘটছে। এর পাশাপাশি প্রতি বছরই জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটছে। সেই চাপও সামাল দিতে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে খাদ্য বণ্টনে।
বর্তমানে শস্য উৎপাদনের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোর ৯৫ শতাংশ ‘জলবায়ু নিরাপদ অঞ্চল’ অথবা ‘পরিবেশের’ মধ্যে পড়ে। তাপমাত্রা যদি ৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়, তাহলে এই অঞ্চলগুলোর অনেক স্থানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাতের ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদনের এই অঞ্চলগুলো ব্যাপকভাবে সংকুচিত হবে।
উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পশুপালনের পাশাপাশি খাদ্যশস্য উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। অনেক এলাকায় ব্যাপক আকারে পানিস্বল্পতা দেখা দিতে পারে। গবেষকেরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্যগুলোর মধ্যে ২৭টি এবং সাত ধরনের গবাদিপশুর ওপর প্রভাব হবে মারাত্মক।
গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ যদি কমানো যায় এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা যায়, তাহলে বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন অঞ্চলগুলোর মাত্র ৫ থেকে ৮ শতাংশ ঝুঁকিতে পড়বে। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যত কমানো যাবে, ততই মঙ্গল হবে মানবজাতির জন্য।
তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরও কিছু অঞ্চলে খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়বে, যেখানে বর্তমানে খুব কম উৎপাদন হয়। এসব অঞ্চলের মধ্যে শীতপ্রধান অঞ্চল নর্ডিক রয়েছে। এ ছাড়া চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ উচ্চমাত্রায় কার্বন নিঃসরণের কারণে দেখা দেবে তীব্র খরা। এতে বিশ্বজুড়ে ৪০ লাখ বর্গকিলোমিটারের বেশি জায়গা মরুভূমিতে পরিণত হবে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যদি দেড় থেকে ২ সেলসিয়াসের নিচে রাখা সম্ভব হয়, তারপরও তুষার অঞ্চলের বনের পরিমাণ কমবে। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে আমেরিকার উত্তরাঞ্চল, রাশিয়া ও ইউরোপের তুষারঘেরা ৭০ লাখ বর্গমাইল বন চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ কমে দাঁড়াতে পারে ৬০ লাখ বর্গমাইলে। আর উচ্চমাত্রায় কার্বন নিঃসরণ ঘটলে সেই বনের মাত্র ৩০ লাখ বর্গমাইল অবশিষ্ট থাকবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ