চার ধাপের ইউপি নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপ হয়ে গেল গত ১১ নভেম্বর। তৃতীয় ধাপের নির্বাচন হবে আগামী ২৮ নভেম্বর। চার ধাপে নির্বাচন সম্পন্ন করার উদ্দেশ্য ছিল মূলত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু গত দুই ধাপের ভোট গ্রহণে হয়েছে এর উল্টো। এমনকি প্রথম ধাপের চেয়ে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে সহিংসতা বেড়েছে অনেকগুণ বেশি।
শত শত সমর্থকের আহত হওয়ার কথা বাদ দিলেও নিহত হওয়ার চিত্রটি খুবই উদ্বেগজনক। প্রথম ধাপে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৫ জন আর দ্বিতীয় ধাপে নিহতের সংখ্যা ২৮। এ ধারাবাহিকতায় তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের কথা চিন্তা করাটাও বেশ ভয়াবহ। কারণ দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন হয় ৮৩৪টি ইউনিয়নে আর তৃতীয় ধাপে নির্বাচন হবে ১ হাজার ৭টি ইউনিয়নে। তাই সহিংসতা বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
সহিংসতা রোধে নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে কমিশনের কার্যকলাপ বিতর্কিত হয়ে পড়বে। তবে আশা কম। কারণ সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এমন ভয়াবহ হানাহানিকে স্রেফ ‘ঝগড়াঝাঁটি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সেক্ষেত্রে আর কী-ই বা আশা করা যেতে পারে!
দুই ধাপে মোট ১ হাজার ১৯৮টি ইউনিয়নে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই ইউপি নির্বাচন বর্জন করেছে। যেহেতু স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হচ্ছে তাই নৌকা প্রতীক থাকলেও ধানের শীষ নেই। তবে হ্যাঁ, বিএনপি সমর্থক বা কোনো কোনো কর্মী-নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত প্রতীক নিয়ে।
নির্বাচন মানেই হলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ভোটারদের ভোট প্রয়োগ। অনেক ক্ষেত্রেই ভোটাররা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ২৫৩ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এটা কোনো নির্বাচনী পরিবেশের ইঙ্গিত বহন করে না। অনেক ক্ষেত্রে হুমকি-ধমকি দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভোটারদের বিকল্প প্রার্থী বেছে নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
এছাড়া, সরাসরি কোনো প্রমাণ না থাকলেও এ নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে এবং তা ব্যাপকভাবে। অভিযোগ উঠেছে, তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই কোনো কোনো প্রার্থী ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্থের বিনিময়ে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছেন। তাদের তৃণমূল পর্যায়ে তেমন সমর্থন নেই। অথচ যাদের সমর্থন আছে তারা অর্থের অভাবে মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এটা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিপন্থি উদাহরণ। জনগণের সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠান হলো ইউনিয়ন পরিষদ। সে প্রতিষ্ঠানটিকে চরমভাবে কলুষিত করা হয়েছে।
এদিকে, প্রথম ধাপের চেয়ে দ্বিতীয় ধাপে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ীর সংখ্যা বেড়েছে বেশি। প্রথম ধাপে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন ২৬ শতাংশ, দ্বিতীয় ধাপে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন ৪২ শতাংশ ইউপিতে। এ বৃদ্ধির হার ৬১ শতাংশেরও বেশি। দ্বিতীয় ধাপের ৮৩৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৩১টিতে সরকারদলীয় প্রার্থী বিজয়ীর ধারেকাছেও যেতে পারেননি। পর্যবেক্ষকরা এ অবস্থাকে মনোনয়ন বাণিজ্যের কুফল হিসাবে দেখছেন।
দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৪ ইউনিয়নের মধ্যে ৩৪১টিতেই নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থীরা জয়ী হতে পারেননি। যে বিএনপি মাঠে নেই সেই দলের নেতাকর্মীরাও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ৬৪ ইউপিতে জয়লাভ করেছেন। মাদারীপুর জেলাকে নৌকার ঘাঁটি হিসাবে দেখা হয়। সেখানকার কালকিনি উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের প্রার্থী নৌকা প্রতীক নিয়ে মাত্র ৩২৫ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন।
স্থানীয় নির্বাচন দলীয়ভাবে হওয়ায় একদিকে প্রার্থী সংখ্যা যেমন কমে গেছে, অন্যদিকে প্রার্থীর গুণগত মানও কমেছে। ফলে ভোটাররা তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিকেও সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। পঞ্চমত, এ নির্বাচনে হানাহানির পরিমাণ অনুমিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। যেহেতু প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি মাঠে নেই, তাই নিজ দলের ভেতর এতখানি সংঘাত-বিরোধ দলীয় ঐক্য-সংহতি ও শক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বৈকি।
রাজনীতির উদ্দেশ্য, মনোয়ন প্রদান, নির্বাচন প্রক্রিয়া সবকিছুতেই চলছে চরম অরাজকতা। বর্তমানে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি হয়ে গেছে জবরদস্তিমূলক। পেশিশক্তি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আশীর্বাদই বিজয়ের একমাত্র নির্ণায়ক। তাই প্রতিদ্বন্দ্বীকে বলপূর্বক মাঠ থেকে বিদায় করাই হলো নির্বাচনি বৈশিষ্ট্য। আমাদের দেশের স্থানীয় নির্বাচন, বিশেষ করে ইউপি নির্বাচনগুলোতে জনসম্পৃক্ততা বেশি থাকে। জাতীয় নির্বাচন ভোটারবিহীন করা গেলেও স্থানীয়ভাবে তা করা যায় না। যে কারণে অনেকে বিদ্রোহী হয়েও প্রার্থী হতে চায় এবং জয়লাভ করে। সেটা মেনে নিতে আবার দলীয় প্রার্থী নারাজ। ফলে বাঁধছে সংঘাত, তা থেকে হানাহনি।
ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে এই যে এত হানাহানি, সংঘাত, অরাজকতা-এর দায়ভার নেবে কে? যেহেতু বিএনপি মাঠে নেই, তাই সম্পূর্ণ দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৪৫
আপনার মতামত জানানঃ