করোনা মহামারিতে বিশ্বে বিপর্যস্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত একটি। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর পাশাপাশি লকডাউনের কারণে নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে দেশটি। এরইমধ্যে বায়ুদূষণের ফলে দৃষ্টিসীমা কমে আসা, দূষণে শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। এর ফলে আগামী সাত দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সব সরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। কর্মীরা বাড়ি থেকে কাজ করবেন। এছাড়া আগামী তিনদিন বন্ধ থাকবে সব নির্মাণকাজও। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এই লকডাউন জারির ঘোষণা দিয়েছেন বলে দেশটির সংবাদসংস্থা এএনআইর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, দূষণ লকডাউন চলাকালীন আগামী সোমবার(আজ) থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহের জন্য দিল্লির সব স্কুল বন্ধ থাকবে। তবে এই সময় শিক্ষার্থীরা স্বশরীরে স্কুলে হাজির হওয়ার পরিবর্তে অনলাইনে ক্লাস করতে পারবেন।
মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন, দিল্লির সব স্কুলের ক্লাস অনলাইনে শুরু হবে। শহরের সব নির্মাকাজ বন্ধ থাকবে এবং সরকারি সব অফিসের কার্যক্রম কর্মীরা বাসা থেকে সম্পন্ন করবেন।
ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, বিষাক্ত বাতাসে দিল্লির আকাশ পুরোপুরি ভারী হয়ে উঠেছে। দিনের বেলায়ও দিল্লিতে অন্ধকার নেমে এসেছে। শিক্ষার্থীদের বিষাক্ত বাতাস থেকে বাঁচাতে দিল্লির সরকার স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দিল্লির বায়ুদূষণ রোধে সরকারের দীর্ঘমেয়াদী জরুরি প্রক্রিয়া দরকার বলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কেজরিওয়াল সরকার চার-স্তরের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দিল্লির এই মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘আগামী সোমবার(আজ) থেকে এক সপ্তাহের জন্য স্কুলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক উপস্থিতি বন্ধ থাকবে; যাতে শিশুদের দূষিত বাতাসে শ্বাস নিতে না হয়। এছাড়া ১৪ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত নির্মাণ কার্যক্রমের অনুমতি দেওয়া হবে না।’
তিনি বলেন, সরকারি সব অফিস আগামী এক সপ্তাহের জন্য শতভাগ কাজ বাসায় থেকে করবে। বেসরকারী অফিসগুলোকে যতটা সম্ভব বাসা থেকে কাজের বিকল্পে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হবে।
গুরুগাঁও, নয়ডা, গাজিয়াবাদসহ দিল্লি এবং এর আশপাশের অঞ্চলে গত সাত দিনের বেশি সময় ধরে মারাত্মক দূষিত বায়ুর চাদরে ঢেকে গেছে। গত সপ্তাহে দেশটিতে দীপাবলি উদযাপনের পর বায়ুদূষণ ব্যাপক আকার ধারণ করে। দিল্লি, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশ সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দীপাবলির সময় হাজার হাজার বাজি ফুটানো হয়। যে কারণে এসব অঞ্চলের বায়ুর মান ভয়াবহভাবে নিচে নেমে যায়।
জাতীয় রাজধানীতে রোববার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে বাতাসের মান ছিল ৩৩০, যা আগের দিন ছিল ৪৩৭। গত শুক্রবারও দিল্লিতে বাতাসের মান ছিল ৪৭১, যা গুরুতর হিসেবে বিবেচিত।
বাতাসের মান এমন অবস্থা হওয়ার কারণ হিসেবে অনেকেই শুধু হরিয়ানা, পাঞ্জাব রাজ্যে ফসলের গোড়া পোড়ানোকে দায়ী করছেন।
বায়ুদূষণের জন্য শুধু কৃষকদের দায়ী করায় ক্ষিপ্ত হয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। তিনি সরকারের সলিসিটরের কাছে জানতে চান, বারবার কৃষকদের বায়ুদূষণের জন্য দায়ী কেন করা হচ্ছে? শুধু কী তারাই এই দূষণের জন্য দায়ী?
সোমবার বাতাসের মানে দিল্লির গাজিয়াবাদ ৩৩১, গুরগাঁও ২৮৭, নয়ডা ৩২১, ফরিদাবাদ ২৯৮ এবং গ্রেটার নয়ডার অবস্থান ৩১০।
সাধারণত এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে ১ থেকে ৫০ অবস্থানে থাকা এলাকাকে ভালো বলা হয়। ১০০ পর্যন্ত সন্তোষজনক, ১০১-২০০ মাঝারি, ২০১-৩০০ খারাপ, ৪০০ পর্যন্ত বেশি খারাপ এবং ৫০০ মাত্রার ওপরে উঠলে সেটাকে বলা হয় গুরুতর।
প্রায় প্রতি বছরই ভারত সরকার অথবা দেশটির সুপ্রিম কোর্ট আতশবাজি পোড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকে। তবে মাঠপর্যায়ে তা খুব কমই কার্যকর হতে দেখা যায়। এর সঙ্গে যোগ হয় দিল্লির প্রতিবেশী পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় কৃষকদের খড় পোড়ানোর মৌসুম। পরবর্তী বছরে চাষের জন্য মাঠ প্রস্তুত করতে পুরোনো খড়কুটোয় আগুন ধরিয়ে দেন কৃষকরা। দিল্লির বায়ুদূষণের জন্য অন্তত ৩৫ শতাংশ দায়ী এ থেকে তৈরি ধোঁয়া।
বায়ুদূষণ ঘিরে যত হইচই দিল্লি ঘিরে। অথচ শুধু দিল্লি নয়, ভারতের একাধিক শহরে বায়ুর মান মোটেও ভালো নয়। যা উঠে এসেছে সুইজারল্যান্ডের জলবায়ু-সংক্রান্ত গোষ্ঠী ‘আইকিউ এয়ার’-এর পরিসংখ্যানে।
আইকিউ এয়ার জাতিসংঘের পরিবেশ-সংক্রান্ত কর্মসূচির সহযোগী। এই গোষ্ঠীর বায়ুর মান ও দূষণের মাত্রা ‘ট্র্যাকিং’ পরিষেবা অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০ শহরের মধ্যে তিনটি শহরই ভারতের। সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে আছে দিল্লি, চতুর্থ স্থানে রয়েছে কলকাতা এবং মুম্বাই আছে ষষ্ঠ স্থানে।
প্রায় প্রতি বছরই ভারত সরকার অথবা দেশটির সুপ্রিম কোর্ট আতশবাজি পোড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকে। তবে মাঠপর্যায়ে তা খুব কমই কার্যকর হতে দেখা যায়। এর সঙ্গে যোগ হয় দিল্লির প্রতিবেশী পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় কৃষকদের খড় পোড়ানোর মৌসুম। পরবর্তী বছরে চাষের জন্য মাঠ প্রস্তুত করতে পুরোনো খড়কুটোয় আগুন ধরিয়ে দেন কৃষকরা। দিল্লির বায়ুদূষণের জন্য অন্তত ৩৫ শতাংশ দায়ী এ থেকে তৈরি ধোঁয়া।
ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নজর দিতে গিয়ে তারা বায়ুদূষণ রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। গত ১ নভেম্বর স্কটল্যান্ডে কপ২৬ সম্মেলনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা দিয়েছেন, ভারত ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনবে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলার এই লক্ষ্যমাত্রায় ভারত অন্তত দুই দশক বেশি সময় নিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা জানান, অবস্থানগত কারণে দিল্লির এই সমস্যা গুরুতর হচ্ছে৷ আশেপাশে কোনো জলাধার না থাকায় ও আবহাওয়ার ধাঁচ শীতপ্রধান ও শুষ্ক হওয়ায় দূষিত বাতাস পালাবার জায়গা পায় না৷ এছাড়া, তীব্র বেগে চলা বাতাস প্রায়ই সাথে করে আরো বাড়তি ধোঁয়া নিয়ে আসে, যা আরো খারাপ করে পরিস্থিতি৷
তারা বলেন, প্রতি শীতেই আমরা বিভিন্ন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিশ্বাসজনিত ও হৃদরোগ-সম্পর্কিত রোগীদের বাড়ন্ত দেখতে পাই৷ দীর্ঘদিন ধরে দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়া স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের বিকাশ রোধ করে৷ দিল্লিতে বর্তমানে প্রতি তিনজনে একজন শিশুর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ বহু শিশুর ফুসফুস সম্পূর্ণ বেড়ে ওঠে না ও সেখানে রক্তক্ষরণও হয়ে থাকে৷
নিকৃষ্ট বাতাসের মান দিল্লির বাসিন্দাদের সবল ফুসফুসকে বিকল করছে৷ এরসাথে উৎসবের মরসুমে আতশবাজির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার প্রতি বছর নভেম্বর মাস থেকে এই মান আরো নিচে নামাতে থাকে৷ অসমর্থ্য ফুসফুস কোভিড সংক্রমণ টেকাতে পারছে না, ফলে হু হু করে বাড়ছে দিল্লিতে দৈনিক সংক্রমণ, মনে করছেন অনেকে৷
২০১৯ সালে কৃষিবর্জ্য পোড়ানো থামাতে আইনী নির্দেশ এলেও, তার বাস্তবায়ন এখনও হয়নি৷ জাতীয় সবুজ ট্রাইবুনাল নভেম্বর মাসে আতশবাজি পোড়ানো বন্ধ করা নিয়ে আলোচনা করছে বলে জানাচ্ছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম৷ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ‘গ্রিন অ্যাপ’ চালু করেছেন, যাতে করে দূষণবিষয়ক নাগরিক নালিশ নথিভুক্ত করা যায়৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, অবিলম্বে শহরে বিকল্প গণপরিবহণের কথা ভাবতে হবে, বাড়াতে হবে সাইকেলের মতো পরিবেশবান্ধব যানচলাচল৷ পুনর্ব্যবহারের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন ও শিল্পক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার চালু করতে হবে বলে পরামর্শ দেন তারা। তবে এসবের কিছুই সরকারী তৎপরতা ছাড়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন তারা৷
তারা জানিয়েছেন, আসলে সরকার ভোট ব্যাংক অটুট রাখতে চায়। হিন্দুদের চটালে তো তারা ভোট পাবে না। পৃথিবীজুড়েই রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পরিবেশ সম্পর্কে অসচেতন। না হলে, সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে, প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে, কিন্তু কেউ জরুরি ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৩
আপনার মতামত জানানঃ