টিকা নিয়ে ইউরোপের স্বার্থপরতার দিকটি বিশ্ববাসী ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছে। বিশ্বের মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এক শতাংশ টিকা দিতে ব্যর্থ হলেও ইউরোপের দেশগুলো ছিল এর থেকে আকাশ-পাতাল এগিয়ে। দেশগুলোতে ৮০ শতাংশের বেশি টিকা দিয়েও এখন ধুঁকছে করোনায়।
শীত ঘনিয়ে আসতেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রেকর্ড হারে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন এ ওয়েভকে ‘গুরুতর উদ্বেগ’ হিসেবে অভিহিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংক্রমণ ঠেকাতে ইউরোপের বেশ কিছু দেশে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। আর টিকা করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ কিনা তা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে।
ইতিমধ্যে ইউরোপের দেশগুলো করোনা রুখতে প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় সব মানুষকে করোনার টিকা দিয়েছেন। তবুও সম্প্রতি জার্মানি থেকে গ্রীস পর্যন্ত করোনার রেকর্ড সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আর রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া তো ভয়াবহ মাত্রায় প্রাণহানি ঘটেছে।
গেল মাসেই সংক্রমণের নতুন ধাক্কায় পড়েছে রাশিয়া। এক মাসেই ৪৪ হাজার মৃত্যু দেখেছে দেশটি। জার্মানিরও বেহাল দশা। এক লাখ মৃত্যু হতে পারে বলে সতর্ক করেছে দেশটির সরকার। আগাম বার্তা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি বলেছে, এ শীতে পুরো ইউরোপকেই ভোগাবে করোনা। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পাঁচ লাখ মৃত্যু হতে পারে এ মহাদেশে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের করা হিসাব অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে বিশ্বে যত জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে, তার অর্ধেকের বেশি এবং মোট মৃত্যুর প্রায় অর্ধেক ইউরোপের। ২০২০ সালের এপ্রিলে সংক্রমণের শীর্ষে ছিল ইতালি। এরপর এ পর্যন্ত ইউরোপে এটিই সবচেয়ে বেশি শনাক্ত ও মৃত্যুহার।
গত সপ্তাহে পুরো বিশ্বের মোট সংক্রমণের অর্ধেকের বেশি ঘটেছে ইউরোপে। জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, অস্ট্রিয়া, রোমানিয়ায় নতুন করে সংক্রমণ ঢেউ আছড়ে পড়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট। ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, ইউরোপে করোনায় মৃত্যু গত সপ্তাহে ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে। সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি ঘটছে নেদারল্যান্ডসে। অথচ এ দেশে ৮৫ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে।
করোনার প্রকোপ আবার বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপে নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের যে চেষ্টা চলছে, তা আবার বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, চেক প্রজাতন্ত্র ও ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে নানা বিধিনিষেধ চালু হয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় নেদারল্যান্ডসে ১৬ হাজার ৩৬৪ জন সংক্রমিত হয়েছেন, যা মহামারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ দৈনিক সংক্রমণ। এ অবস্থায় নেদারল্যান্ডস সরকার তিন সপ্তাহের জন্য আংশিক লকডাউন ঘোষণা করতে চলেছে। অতি প্রয়োজনীয় নয়, এমন সবকিছু বন্ধ রাখা হবে। বিভিন্ন খেলার টুর্নামেন্টগুলোও বন্ধ থাকবে বলে জানা গেছে।
গত এক সপ্তাহে বিশ্বে যত জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে, তার অর্ধেকের বেশি এবং মোট মৃত্যুর প্রায় অর্ধেক ইউরোপের। ২০২০ সালের এপ্রিলে সংক্রমণের শীর্ষে ছিল ইতালি। এরপর এ পর্যন্ত ইউরোপে এটিই সবচেয়ে বেশি শনাক্ত ও মৃত্যুহার।
অস্ট্রিয়া সরকার জানিয়েছে, যাদের টিকা দেওয়া হয়নি, তাদের গতিবিধিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। অস্ট্রিয়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১১ হাজার মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন। অস্ট্রিয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় রেখেছে জার্মানি। জার্মানিতেও নতুন করোনা-বিধিতে জানানো হয়েছে, টিকা নেওয়া না-থাকলে পানশালা, রেস্তোরাঁ বা কোনো বদ্ধ জায়গায় প্রবেশ করা যাবে না।
নতুন সংক্রমণ ঢেউ থেকে বাঁচতে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু করছে নরওয়েতে। যারা টিকা নেননি এখনও, তাদের সপ্তাহে দুই বার করোনা-পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দিয়েছে সরকার। নরওয়েতে ৮৭ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়ে গেছে।
বিশেষত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোয় কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় বড়দিনের ছুটির আগেই চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত কিনা তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কীভাবে আরও বেশি মানুষকে টিকাদানের আওতায় আনা যায় তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপের আঞ্চলিক প্রধান হানস ক্লুগ বলেন, “ইউরোপের ৫৩টি দেশে সংক্রমণের চলতি অবস্থা ভয়াবহ উদ্বেগজনক।
অধিক সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে এ সংক্রমণ আরও বেড়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
শীতের সময় যখন বাসা-বাড়িতে মানুষের জমায়েত বেড়ে যায়, ভাইরাসটি আরও অধিক হারে সংক্রমিত হয়।সংক্রমণ ঠেকাতে ইউরোপ যদি বর্তমান পন্থাই অনুসরণ করে, তাহলে সামনের বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ এ অঞ্চলে আরও পাঁচ লাখ কোভিডজনিত মৃত্যু হতে পারে বলে সতর্ক করেন ক্লুগ।
শুক্রবার ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এক সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছে, ‘মহামারির সামগ্রিক পরিস্থিতি… উচ্চ ও দ্রুত ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ হার এবং ধীর ও ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর হার চিহ্নিত হয়েছে। সংক্রমণ হার, মৃত্যুর হার এবং হাসপাতাল ও আইসিইউ ভর্তি সবই আগামী দুই সপ্তাহে বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।’
সাপ্তাহিক ঝুঁকি পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, সবচেয়ে উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, ইস্তোনিয়া, গ্রিস, হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড ও স্লোভেনিয়া। আগামী কয়েক সপ্তাহে এসব দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ বাড়তে পারে।
এদিকে দীর্ঘ কয়েক মাসের বিরতি শেষে জার্মানিতে হঠাৎ করেই গত কয়েক দিনে আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। একই সাথে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। জার্মানির বিশিষ্ট এক ভাইরাস বিশেষজ্ঞ বেড়ে চলা করোনা সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ভয়াবহ পূর্বাভাস দিচ্ছেন৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে কমপক্ষে আরো এক লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করছেন তিনি৷
জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে জানাচ্ছে, জার্মানিতে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে গড় সাপ্তাহিক সংক্রমণের হার ২৩২ পেরিয়ে গেছে৷ পরিস্থিতির লাগাতার অবনতির ফলে করোনা টিকা নিতে অনিচ্ছুক মানুষের উপর আরও নিষেধাজ্ঞা চাপানোর ডাক জোরালো হচ্ছে৷ সেইসঙ্গে হাসপাতালগুলিতে করোনা রোগীর ভিড়ের কারণে গুরুতর অসুস্থ অন্যান্য মানুষের চিকিৎসা ও অপারেশনে বিঘ্ন ঘটায় দুশ্চিন্তা বাড়ছে৷ দলীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা বর্জন করে গোটা দেশজুড়ে অবিলম্বে অভিন্ন কড়া বিধিনিয়ম চাপানোর দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা৷
জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়ান স্পান সবাইকে টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়ার পক্ষে বলেছেন। জার্মানিতে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সংগঠন লিওপোল্ডিনা এক বিবৃতিতে বলেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে জার্মানির নীতিনির্ধারকেরা করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের বিষয়ে তেমন প্রস্ততি গ্রহণ করেননি। বিশেষজ্ঞরা টিকা নিতে অনীহা প্রকাশকারীদর বিষয়ে বাধ্যতামূলক টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর তুলনায় জার্মানিতে টিকা দেওয়ার ধীরগতির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, জার্মানিতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর এটিও একটি কারণ।
ফাইজার–বায়োএনটেকের করোনার টিকার অন্যতম আবিষ্কারক উগুর সাহিন ফ্রাঙ্কফুর্ট রন্ডসুউ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, টিকা দেওয়ার পর সপ্তম, অষ্টম বা নবম মাসে অ্যান্টিবডির মাত্রা কমতে শুরু করে এবং এতে করে করোনার সংক্রমণ ঘটতে পারে। তবে টিকার বুস্টার ডোজ ভাইরাস প্রতিরোধক্ষমতা পুনরুদ্ধার করে, যা করোনার ডেলটা ধরনের ক্ষেত্রেও কাজ করে। বুস্টার টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রোগের ভয়াবহতা সাধারণত মাঝারি হয় এবং খুব কম ক্ষেত্রেই গুরুতর অসুস্থতা লক্ষ করা যায়।
এদিকে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে লাখো মানুষ করোনাভাইরাসের টিকার অপেক্ষায় আছেন। আর এসব দেশে ব্যাপক অর্থে হার্ড ইমিউনিটি এখনও কল্পনাতীত। টিকাদানের হার মন্থর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায়। মহামারিতে সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশগুলো এখন এই দুটি এলাকায়। কর্তৃপক্ষ পড়েছেন দ্বিমুখী সংকটে। টিকাদান ছাড়া কীভাবে মৃত্যু কমানো যাবে এবং মানুষকে আর ঘরে রাখা যাচ্ছে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৯
আপনার মতামত জানানঃ