মিয়ানমারে আটক হওয়া মার্কিন এক সাংবাদিককে ১১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন জান্তা-শাসিত দেশটির একটি আদালত। কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ওই মার্কিন সাংবাদিকের নাম ড্যানি ফেনস্টার। ফেনস্টারের বিরুদ্ধে আনা অভিবাসন আইন লঙ্ঘন, বেআইনি যোগাযোগ এবং সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ভিন্নমতকে উসকে দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে এই কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আজ শুক্রবার এই দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
গত ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে আটক করে সামরিক বাহিনী। মার্কিন সাংবাদিক ফেনস্টার তাদের মধ্যে একজন।
৩৭ বছর বয়সী ড্যানি ফেনস্টার ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার নামক অনলাইন পোর্টালের কর্মী ছিলেন। তিনি প্রায় এক বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছিলেন। গত মে মাসে রেঙ্গুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গত সপ্তাহে রাষ্ট্রদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদের দুটি অভিযোগ আনা হয় ফেনস্টারের বিরুদ্ধে। মিয়ানমারে এসব অভিযোগের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে নতুন এ দুটি অভিযোগের রায় এখনও আসেনি।
এদিকে ড্যানি ফেনস্টারের কর্মস্থল ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ফ্রন্টিয়ারের সবাই এই সিদ্ধান্তে হতাশ।
ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমারের এডিটর-ইন-চিফ থমাস কিন জানিয়েছেন, ‘যেসব অভিযোগে ড্যানিকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। কারাদণ্ডের এই রায়ে ফ্রন্টিয়ারের সবাই খুবই হতাশ। আমরা তার দ্রুত মুক্তি চাই যেন তিনি পরিবারের কাছে যেতে পারেন।’
ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার জানায়, মিয়ানমার নাওয়ে কাজের ভিত্তিতে ড্যানির বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো আনা হয়। ২০২০ সালের জুলাইয়ে তিনি মিয়ানমার নাও থেকে পদত্যাগ করেন। পরে তিনি ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমারে যোগ দেন। ২০২১ সালের মে মাসে তাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তিনি ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমারের হয়ে কাজ করছিলেন। এখানে তিনি নয় মাসের বেশি সময় ধরে কাজ করছিলেন।
ড্যানিকে মুক্তি দিতে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ওপর চাপ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফেনস্টারের আটককে ‘খুব অন্যায়’ বলে মন্তব্য করেছিল৷ তাকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে সামরিক বাহিনীর প্রতি আহ্বানও জানানো হয়েছিল৷
তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই চাপ মিয়ানমারের জান্তা আমলে নেয়নি। উল্টো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র বলেন, ড্যানিকে আটকে রাখার যৌক্তিকতা রয়েছে।
গত সপ্তাহে রাষ্ট্রদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদের দুটি অভিযোগ আনা হয় ফেনস্টারের বিরুদ্ধে। মিয়ানমারে এসব অভিযোগের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে নতুন এ দুটি অভিযোগের রায় এখনও আসেনি।
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সুচির নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। রক্তপাতহীন এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং। অং সান সুচি ও তার দল এনএলডির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা বর্তমানে গৃহবন্দি বা কারাবন্দি অবস্থায় আছেন।
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটির গণতন্ত্রপন্থি মানুষের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরাও দমনপীড়ন, হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তারের শিকার হচ্ছেন। মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর প্রায় ৮০ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে ৫০ জন এখনো বন্দী।
এর প্রেক্ষিতে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে নিন্দার ঝড় বইতে থাকে। চাপ আসতে থাকে। সামরিক সরকারের নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবরোধ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তার সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে আসিয়ানের অবস্থান। তারা কার্যত আসিয়ান সম্মেলনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কোনো প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, গত এপ্রিলে মিয়ানমার আসিয়ানে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নেয়া। মানবিক সহায়তা দেয়ার পথ উন্মুক্ত করা এবং বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা। এর মধ্যে কোনোটিই বাস্তবায়ন করেনি সামরিক জান্তা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষমতা দখলের পর এপ্রিল মাসে জাপানের এক সাংবাদিককে আটক করে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর আগে মার্চ মাসে বিবিসির এক সাংবাদিককে স্বল্প সময়ের জন্য আটক করা হয়। তার আগে পোল্যান্ডের এক ফটো সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে মার্চে অবশ্য তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পর জান্তার হাতে ১ হাজার ১৭৮ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭ হাজার ৩৩৫ জনকে।
এদিকে দুর্নীতির অভিযোগে স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দী নেত্রী অং সান সু চির দলের দুই সদস্যকে ৯০ ও ৭৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন দেশটির একটি আদালত। দণ্ডিত ওই নেতাদের আইনজীবী এসব তথ্য জানিয়েছেন।
দেশটির কাইন প্রদেশের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী থান নাইংকে দুর্নীতির ছয়টি অভিযোগে অভিযুক্ত করে প্রাদেশিক একটি আদালত তাকে ৯০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন। তার আইনজীবী জাও মিন হ্ল্যাইং জানিয়েছেন, ৬টি অভিযোগের প্রতিটিতে ১৫ বছর করে মোট ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
হ্ল্যাইং বলেছেন, একই দিনে কাইন প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ৬৭ বছর বয়সী নান খিন হতে মিইন্তকে মোট পাঁচটি অভিযোগে অভিযুক্ত করেন আদালত। প্রতিটি অভিযোগে ১৫ বছর করে তাকে মোট ৭৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। নান খিন হতে মিইন্ত অং সান সু চির দল এনএলডির শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা।
এদিকে মিয়ানমারের মানবিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের সাহায্যবিষয়ক প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস। গত সোমবার সতর্ক করে গ্রিফিথস বলেন, মিয়ানমারে ক্রমবর্ধমান সংঘাত এবং পতনের মুখে থাকা অর্থনীতির কারণে ৩০ লাখ মানুষের জীবন রক্ষাকারী সহায়তার প্রয়োজন।
গ্রিফিথস বলেন, মানবাধিকারকর্মী ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসামরিক জনগণ ও অবকাঠামোর ওপর হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে নিষিদ্ধ। এ ধরনের হামলা বন্ধ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১০০
আপনার মতামত জানানঃ