সাড়ে ছয় কোটি বছর আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে বিশাল দেহের বিভিন্ন প্রজাতির এক একটি ডাইনোসর। ডাইনোসর নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই জনমনে। বিজ্ঞানীরাও এ নিয়ে দিনের পর দিন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এবার সাফল্যের তালিকায় যুক্ত হলো আরেকটি পালক। অদ্ভূত নাকের নতুন প্রজাতির ডাইনোসরের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা। এতে নতুন কিছু তথ্যও উদ্ধার করেছেন তারা।
নতুন এক প্রজাতির ডাইনোসরের সন্ধান মিলেছে যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ উপকূলের আইল অব রাইট দ্বীপে। সেখানে প্রজাতিটি শনাক্ত করেন পিএইচডির শিক্ষার্থী জেরেমি লকউড। তিনি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথে গবেষণা করছেন। বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রায় চার দশক আগে বেশ কিছু ডাইনোসরের হাড়গোড় পাওয়া গিয়েছিল। যুক্তরাজ্যের উত্তর উপকূলে আইলে অব রাইট দ্বীপে খোঁজ মিলেছিল এইসব হাড়গোড়ের। সম্প্রতি একটি গবেষণায় উঠে আসছে এক অবিশ্বাস্য তথ্য। তা হল, এতদিন আমরা ডাইনোসরের যে যে জীবাশ্মের সন্ধান পেয়েছি, সে সবের সঙ্গে এর কোনওই মিল নেই। এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রজাতি। এটির নাক আগে সন্ধান পাওয়া প্রজাতিগুলোর তুলনায় বেশ লম্বা।
ইউনিভার্সিটি অফ পোর্টসমাউথে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন পিএইচডির শিক্ষার্থী জেরেমি। তার কথা অনুযায়ী, এই নয়া প্রজাতির নাক আমাদের চেনা পরিচিত ডাইনোসরদের তুলনায় অনেকটাই লম্বা। এছাড়া চোয়ালে দাঁতের সংখ্যা ২৮টি এবং নখগুলিও আকারে বেশ বড়।
এই বিষয়ে জেরেমি বলেন, ‘এক শতকের বেশি সময় ধরে আমরা জানি ডাইনোসর মূলত দুই প্রজাতির। এগুলোর ২৩ কিংবা ২৪টি দাঁত রয়েছে। তবে নতুন এই প্রজাতির দাঁতের সংখ্যা ২৮। এটির নাকের আকারও বেশ বড় ও লম্বা। ছোট এই পার্থক্যগুলো নতুন প্রজাতিটিকে আগেরগুলোর থেকে আলাদা করেছে।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডাইনোসরের হাড়গুলো ১৯৭৮ সালে আবিষ্কার করা হয়েছিল। সেগুলো লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম ও ইসলে অব রাইট দ্বীপের ডাইনোসর জাদুঘরে সংরক্ষিত ছিল। জেরেমি চার বছর ধরে এসব হাড়গোড় নিয়ে গবেষণা করছেন। করোনার বিধিনিষেধ চলাকালে খণ্ড খণ্ড হাড়গুলো পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখতে পান, এটি আগে সন্ধান পাওয়া প্রজাতির চেয়ে ভিন্ন।
জেরেমি এই নতুন প্রজাতিটির নাম দিয়েছেন, ব্রাইস্টোনেয়াস সিমোনদসি। যার গড় ওজন ৯৫০ কিলোগ্রাম মনে করা হচ্ছে। লম্বায় প্রায় ৮ মিটার।
‘জার্নাল অব সিস্টেমেটিক প্যালায়েনতোলজি’তে সম্প্রতি এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। জেরেমি সেখানে প্রজাতিটির উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করে বলেন, কোভিডের জন্য এখন সর্বত্র বিধিনিষেধ। এর মাঝে এর চেয়ে ভাল আবিষ্কার আর কীই-বা হতে পারে? এই প্রজাতি একটিই বিষয় ইঙ্গিত করে। তা হল আমাদের জানার বাইরেও অনেক প্রজাতির ডাইনোসর একসময় ছিল।
পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিদায় নিয়েছে বহু আগেই। তবে অতিকায় প্রাণীটি নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। বিভিন্ন সময় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে উদ্ধার হয়েছে ডাইনোসরের জীবাশ্ম। উন্মোক্ত হয়েছে অনেক রহস্য।
বিশাল শরীর আর দাপুটে মেজাজ নিয়ে প্রায় ১৭ কোটি বছর পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে ডাইনোসর। পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের প্রাগৈতিহাসিক অধিবাসী এবং বৈজ্ঞানিকদের অনুমান প্রভাবশালী প্রাণী এরা। প্রথম ডাইনোসরের বিবর্তন হয়েছিল আনুমানিক ২৩ কোটি বছর পূর্বে। কোটি কোটি বছর আগে তা বিলুপ্তও হয়ে গিয়েছে।
তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ডাইনোসর নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। আগ্রহের শেষ নেই বিজ্ঞানী ও গবেষকদেরও। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের আরেক নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন। ব্রাজিল থেকে এই ফসিলটি আবিষ্কার করে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ডাইনোসরের এই প্রজাতিটি ৭ কোটি বছর আগে দক্ষিণপূর্ব আমেরিকায় ঘুরে বেড়াত।
এই ডাইনোসর প্রজাতির নাম ‘কুরুপি ইটাটা’। গবেষণার নেতৃত্বে যিনি আছেন তিনি জানান, এই ‘কুরুপি ইটাটা’ চতুষ্পদ ডাইনোসর, এর দৈর্ঘ ১৬ ফুট। পরীক্ষায় জানা গিয়েছে, এই ধরনের ডাইনোসরের পেশি ও হাড়ের সংস্থান থেকে বোঝা যাচ্ছে, এরা ভালরকম দৌড়ত।
২৩১ থেকে ২৪৩ মিলিয়ন (২৩.১-২৪.৩ কোটি) বছরের মধ্যে ডাইনোসরের প্রথম আবির্ভাব। ১৭.৭ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে এদের বিচরণ ছিল। পাখিসদৃশ ডাইনোসর ছাড়া ৬ কোটি ৫৫ লাখ বছর আগে এদের বিলুপ্তি ঘটে। সে সময় ঠিক কী ঘটেছিল, বিজ্ঞানীরা সে বিষয়ে পুরো একমত নন। কিন্তু এই বিলুপ্তির পেছনে উল্কাপাত বা গ্রহাণুর আঘাতকে বেশ বড় করে দেখা হয়। এ ছাড়া অগ্ন্যুত্পাত থেকে রাসায়নিক নিঃসরণ, জলবায়ু পরিবর্তনসহ অন্য কারণগুলোও বিবেচনা করা হয়।
ধারণা করা হয়, ৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে অন্তত ১০-১৫ কিলোমিটার প্রশস্ত গ্রহাণুর আঘাতের পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু গত বছর যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব রিডিং ও ব্রিস্টলের বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের ফসিলের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন, ওই উল্কাপাত বা গ্রহাণুর আঘাতের অন্তত ৫ কোটি বছর আগেই ডাইনোসরদের বিলুপ্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। গ্রহাণুর আঘাতে সেটি শেষ হয় মাত্র। পরিবর্তিত পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার কারণেই ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল বলে তারা মনে করেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ডাইনোসরের জন্মের সময় পৃথিবী ছিল উষ্ণ। কিন্তু দিনে দিনে পৃথিবী শীতল হয়ে আসতে শুরু করে। সমুদ্রের পানির উচ্চতাও নেমে যেতে শুরু করে। এর ফলেই ডাইনোসর বিলুপ্ত হতে শুরু করে। ডাইনোসরের সঙ্গে স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্ম অনেকটা একই সময়ে হলেও স্তন্যপায়ী প্রাণীরা শীতল পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩১
আপনার মতামত জানানঃ