পারমাণবিক শক্তির জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার বিষয়টি ইরান বরাবরই অস্বীকার করলেও পশ্চিমা বিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দেশটির অন্যতম শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিজাদাহকে তার দেশের গোপন পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির মূল পরিকল্পনাকারী ও ইরানের ‘বোমার জনক’ বলে দাবী করে আসছিল।
শুক্রবার তেহরানের কাছে দামাভান্দ কাউন্টির আবসার্ড এলাকায় সন্ত্রাসীদের বোমা হামলার শিকার হওয়ার পর হাসপাতালে নেয়া হলে মারা যান ফখরিজাদাহ। জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হস্তক্ষেপে ২০০৩ সালে বন্ধ করে দেয়া এক সমন্বিত পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিতে তিনি নেতৃত্ব দেন বলে পশ্চিমা শক্তিগুলো দীর্ঘদিন ধরে দাবী করে আসছিল।
পশ্চিমা বিশ্বের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে বেসামরিক ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির নেতৃত্ব দেয়া ও পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহে ইরানের আগের পদক্ষেপে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন ফখরিজাদাহ। যদিও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি চেষ্টার অভিযোগ ইরান বরাবরই অস্বীকার করে আসেছে।
ফখরিজাদাহ সব সময় কড়া নিরাপত্তার মধ্যে বাস করতেন এবং এ বিজ্ঞানীকে জাতিসংঘের পারমাণবিক তদন্ত কর্মকর্তাদের সামনেও হাজির করেনি ইরান। তিনি খুব কমই প্রকাশ্যে আসতেন। বাইরের খুব কম লোকই তার চেহারা কেমন বা তার সাথে দেখা হয়েছে তা বলতে পারবে না।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) ২০১৫ সালের চূড়ান্ত মূল্যায়ন তালিকায় একমাত্র ইরানি বিজ্ঞানী হিসেবে ফখরিজাদাহর নাম উল্লেখ করে। দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি সামরিক খাতে ব্যবহারের অংশটি দেখাশোনা করতেন তিনি।
জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের গোপন পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্প হিসেবে কথিত আমাদ পরিকল্পনার দেখভাল করতেন তিনি। সংস্থাটি তাদের ২০১১ সালের প্রতিবেদনে তাকে আমাদ পরিকল্পনার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখ করে বলে, ইরানের পারমানবিক বোমা তৈরির দক্ষতা এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনে তার সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে।
ইরানের আমাদ পরিকল্পনাকে গোপন পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্প হিসেবে বর্ণনা করে ইসরায়েল দাবি করেছে তারা ইরানি পারমাণবিক প্রকল্পের ‘আর্কাইভের’ বিশাল এক অংশ জব্দ করেছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ২০১৮ সালে এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে মোহসেন ফখরিজাদাহকে আমাদ পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন এবং আমাদকে বেসামরিক কর্মসূচির আড়ালে পরিচালিত গোপন পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন তিনি।
নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েলি এজেন্টরা তেহরানের একটি সাইট থেকে প্রচুর নথি উদ্ধার করেছে। যদিও নথিগুলো জাল বলে দাবি ইরানের। ফখরিজাদাহকে আমাদের প্রধান হিসেবে বর্ণনা করে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘ফখরিজাদাহের নামটি মনে রাখবেন।’
ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট ২০১৮ সালে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বলে ইরানের দাবী। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ফখরিজাদাহকে ভালো করেই চিনি। তিনি নিজেই জানেন না আমি তাকে কত ভালোভাবে চিনি। আমি যদি তাকে রাস্তায়ও দেখি তবে চিনতে পারব।’
শুক্রবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ফখরিজাদাহকে দেশটির গবেষণা ও উদ্ভাবনী সংস্থার প্রধান হিসেবে উল্লেখ করেছে। আইএইএ বহুদিন ধরে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে ফখরিহজাদাহকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অপেক্ষায় ছিল।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েক বছর আগে ফখরিজাদাহের কথা স্বীকার করে ইরান। তবে তারা বলেছে সেনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও পারমাণবিক কর্মসূচিতে তিনি জড়িত ছিলেন না। তেহরানের এত গোপনীয়তা মেনে চলার অন্যতম কারণ হয়তো ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ইরানের চারজন পরমাণু বিজ্ঞানীর হত্যার শিকার হওয়া।
ইরানের বিশিষ্ট এ বিজ্ঞানী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন বলে একটি সূত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছে। অনেকে তাকে এ প্রকল্পের জনক বলে থাকেন।
ন্যাশনাল কাউন্সিল অব রেজিস্ট্যান্স অব ইরান (এনসিআরআই) নামে একটি গ্রুপ ২০১১ সালে মাথা ভর্তি কালো চুল এবং গোঁফসহ ফখরিজাদাহর বেশ কিছু ছবি প্রকাশ করে। যদিও প্রকাশিত এসব ছবির সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
এনসিআরআইর দেয়া তথ্যমতে, মোহসেন ফখরিজাদাহ ১৯৫৮ সালে কোম শহরে এক শিয়া মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইরানের ইমাম হুসেইন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফখরিজাদাহ দেশটির উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্বও পালন করেছেন।
ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনির এ সমর্থককে ইরানের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ বলে দেশটির এক সূত্র ২০১৪ সালে রয়টার্সকে জানিয়েছিল। সূত্রটি আরও জানায় যে ফখরিজাদাহের তিনটি পাসপোর্ট ছিল এবং হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহের জন্য এ বিজ্ঞানী এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রচুর ভ্রমণ করতেন।
এদিকে মোহসেন ফখরিজাদাহ হত্যার ঘটনায় কঠিন প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দিয়েছে ইরান। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সামরিক উপদেষ্টা হোসেইন দেহগান এই হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের ওপর বজ্রের মত ‘আঘাত হানা’ হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ এই ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের’ নিন্দা জানাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। জারিফ হামলার জন্য ইসরায়েলকে দোষারোপ করে বলেন, ‘ইসরায়েলের এতে জড়িত থাকার গুরুতর ইঙ্গিত রয়েছে।’
জাতিসংঘের ইরানের রাষ্ট্রদূত মজিদ তখত রাভঞ্চি বলেন, এই হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যা এই অঞ্চলে বিপর্যয় ডেকে আনার জন্য করা হয়েছে।
তবে হত্যার ব্যাপারে ইসরাইলের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
ইউএনবি, রয়টার, আলজাজিরা
আপনার মতামত জানানঃ