দাবানল, দাবদাহ, খরা, বন্যা, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন দেশে এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। চীন, ভারত ও জার্মানিতে চলতি মৌসুমে কয়েক দফা বন্যা, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মুখে পড়েছে। গ্রিস, তুরস্ক, ইতালিসহ দক্ষিণ ইউরোপ পুড়ছে দাবানলে। বেলজিয়ামসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ রেকর্ড বৃষ্টিপাত দেখেছে। ব্রাজিল, মাদাগাস্কারসহ গোটা আফ্রিকা খরায় বিপর্যস্ত। যখন জলবায়ুর এমন চরম বৈরিতার মুখে বিশ্ব, এমন সময় এসব দুর্যোগের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রায় ৩০০ বছর আগে শিল্পভিত্তিক সভ্যতায় প্রবেশ করেছে মানবজাতি। দিন যত যাচ্ছে, পুরো উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া ও মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে উঠছে কলকারখানা ও শিল্প-প্রযুক্তি নির্ভর। কিন্তু এই সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে শিল্প-কলকারখানা ও যানবাহনে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর ফলে বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে মানবজাতির সামনে, যার উপসর্গ বা লক্ষণ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
গতকাল জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ বন্যা, ঝড় ও সুনামির কবলে পড়বে।
বিশ্ব সুনামি সচেতনতা দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ১০০ বছরে সংঘটিত সুনামির কারণ, সমাজের ওপর প্রভাব, পরবর্তী ঝুঁকি এবং প্রাণহানির একটি তালিকা তৈরি করেছে। তালিকায় শ্রীলঙ্কা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং জাপান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, সঠিক জায়গায় সঠিক ব্যবস্থা আগে থেকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে সেটা সম্ভাব্য বিপর্যয় প্রতিরোধে কিছুটা সাহায্য করতে পারে।
সুনামিকে অন্যতম বিপজ্জনক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, সুনামি-প্রবণ এলাকায় নগরায়ণ এবং পর্যটন প্রতিরোধ করা উচিত, অন্যথায় অনেকেরই প্রাণের ঝুঁকি থাকবে।
জাতিসংঘ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, গত ১০০ বছরে ৫৮টি সুনামিতে আনুমানিক দুই লাখ ৬০ হাজার মানুষ মারা গেছে।
বিশ্ব সুনামি সচেতনতা দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ১০০ বছরে সংঘটিত সুনামির কারণ, সমাজের ওপর প্রভাব, পরবর্তী ঝুঁকি এবং প্রাণহানির একটি তালিকা তৈরি করেছে। তালিকায় শ্রীলঙ্কা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং জাপান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চীনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত ও বন্যা, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশে ভয়ানক দাবানল ও তাপপ্রবাহের পর সম্পতি আরও একটি রেকর্ড হয়েছে। সারা বছর বরফে ঢেকে থাকা গ্রিনল্যান্ডের সর্বোচ্চ বরফচূড়ায় প্রথমবারের মতো বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটেছে। ছিটেফোঁটা নয়, কয়েক ঘণ্টা ধরে বেশ ভালো মাত্রায় বৃষ্টি ঝরেছে সেখানকার বরফচাঁইয়ের ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উষ্ণায়নের ফলে মেরুঅঞ্চলের বরফ যে হারে গলছে, তাতে এই বৃষ্টিপাতকে নতুন উদ্বেগ হিসেবে দেখছেন বিজ্ঞানীরা।
তাপমাত্রা যেখানে সাধারণত হিমাঙ্কের ওপর ওঠে না, সেখানেই মূষলধারে বৃষ্টি হলে তা নিঃসন্দেহে বিস্মিত হওয়ার মতো। আর এই বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে গ্রিনল্যান্ডের বরফচূড়ায়। শুধু তাই নয়, প্রথমবার সেখানে বৃষ্টি হয়েছে, তাও কয়েক ঘণ্টা ধরে। এই ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করার পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ওই বরফচূড়ায় তাপমাত্রা বেড়ে হিমাঙ্কের ওপরে উঠে যাওয়ায় এমনটি ঘটেছে। একে আশীর্বাদ নয়, বরং অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন তারা।
বিজ্ঞানীদের মতে, মানবসৃষ্ট কারণে কার্বন নিঃসরণ বেড়ে চলায় পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এর প্রভাবে গলছে বরফ, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ১৯৯৪ সাল থেকে গ্রিনল্যান্ডের কয়েক ট্রিলিয়ন টন বরফ গলে গিয়ে বেড়েছে সমুদ্রের উচ্চতা; ঝুঁকির মুখে ফেলেছে সারা বিশ্বের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের কোটি মানুষকে। এরই মধ্যে সমুদ্রের উচ্চতা ২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে এবং চলতি শতকের শেষ নাগাদ উচ্চতা বাড়তে পারে আরও ২৮ থেকে ১০০, এমনকি ২০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন তুঙ্গে। এখন পর্যন্ত রেকর্ড বইয়ের তথ্যে এ বছরের জুলাই মাসটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। এমনটাই জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান এবং জলবায়ু বিষয়ক গবেষণা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা ন্যাশনাল ওশনিক অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নোয়া)।
এর আগে, জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব নিয়ে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্ব উত্তপ্তকারী বিপজ্জনক গ্যাস নির্গমন অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষ দিকে সামুদ্রিক পানির উচ্চতা দুই মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
জাতিসংঘের মহাসচিব এটিকে ‘মানবতার জন্য লাল সংকেত’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা যদি এখনই সব শক্তি একত্রিত করি, তাহলে জলবায়ু বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। প্রতিবেদন এটি পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, দেরি করার মতো সময় নেই আর কোনো অজুহাতেরও জায়গা নেই।
জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগে ১০০ বছরে জলবায়ুর যে পরিবর্তন হতো, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি ছয় থেকে নয় বছরে তা ঘটবে। এই শতাব্দীজুড়ে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে জলস্তর বাড়বে, ভাঙন দেখা দেবে, অনেক শহর পানিতে তলিয়ে যাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গ্রিনল্যান্ডে বৃষ্টিপাত মানবজাতির জন্য সর্বোচ্চ সতর্কবার্তা। মানবগ্রহকে রক্ষায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা এখনই কমাতে হবে, হাতে একদিনও সময় নেই। না হলে বিপন্নতার মুখে পড়বে সভ্যতা।
তারা বলেন, প্রাকৃতিক নিয়মে পৃথিবীর বিষুবরেখা সংলগ্ন অঞ্চলে গ্রীষ্মের তীব্রতা থাকায় বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। তবে এখন বিশ্ব জলবায়ু উষ্ণায়নের কারণে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে হিমবাহ গলে যাচ্ছে, কম তুষারপাত ও গরমকালে অতিরিক্ত গরম ও অতিবৃষ্টির ঘটনা ঘটছে। এখন ভাবার সময় এসেছে, পৃথিবীকে বাঁচাতে বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষকে সজাগ হওয়ার। নইলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার সীমারেখা মানছে না, সে হোক উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩২
আপনার মতামত জানানঃ