‘এই পরিবর্তন নাটকীয়, গভীর পরিবর্তন।’ গত কয়েক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে মার্কিন জনমতের ওপর নজর রাখা যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত জনমত জরিপকারী জন যগবি যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্ক প্রসঙ্গে বলছেন এমনটাই। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্ম এখন ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে অনেক সহানুভূতিশীল। এই পরিবর্তনের প্রতিফলন পড়ছে দেশটির বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে।
তবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেছেন। বার বার তিনি বলেছেন আত্মরক্ষার অধিকার ইসরায়েলের রয়েছে। কিন্তু দলের ভেতর তিনি বেশ বেকায়দায় পড়ছেন। কারণ ডেমোক্র্যাট শিবিরে এখন গাজা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনদের অবস্থা নিয়ে অনেক বেশি উদ্বেগের সুর শোনা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির জন্য ইসরায়েলকে সরাসরি দায়ী করা হচ্ছে। এবার যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকাভুক্ত হলো ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থা।
যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকাভুক্ত
ইসরায়েলি সাইবার গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা প্রযুক্তিবিষয়ক সংস্থাকে (এনএসও) কালো তালিকাভুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এনএসওর তৈরি স্পাইওয়্যার পেগাসাসের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী ও রাজনীতিকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফোনে নজরদারি চালানোর ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় বুধবার এই সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে মার্কিন কমার্স ডিপার্টমেন্ট এক বিবৃতিতে জানায়, এই স্পাইওয়্যারের কারণে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন সরকার তাদের দেশের মধ্যে দমন-পীড়ন পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে সাংবাদিক ও আন্দোলনকর্মীসহ বিরোধী পক্ষের টুটি চেপে ধরার মতো স্বৈরাচারী আচরণ করা সহজ হয়েছে ওইসব দেশের সরকারের জন্য।
এই স্পাইওয়্যার তৈরি করে বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে বিক্রির অভিযোগ উঠেছিল এনএসও’র বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালে এই স্পাইওয়্যারের বিষয়টি সংবাদ শিরোনামে এসেছিল। ২০১৬ সাল থেকে এনএসওর গ্রাহকেরা এসব নম্বরে আড়ি পেতেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে ২০১৪ সালে পেগাসাসের প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল। এক আরব মানবাধিকার কর্মীর আইফোন হ্যাক করার সময় এই সফটওয়ার ব্যবহার করা হয়েছিল। এরই জেরে আইফোন প্রস্তুতকারক সংস্থা অ্যাপল ঘটনার কয়েক দিন পর তাদের অপারেটিং সিস্টেম আপডেট প্রকাশ করেছিল।
২০১৭ সালে সাইবার সুরক্ষা গবেষকরা জানিয়েছিলেন, এ ধরনের সফটওয়্যার অ্যান্ড্রয়েডভিত্তিক স্মার্টফোনে সহজেই ব্যবহার করা যায়। ২০১৯ সালে এনএসওর সঙ্গে পেগাসাস নিয়েই ফেসবুকের মতোবিরোধ প্রকাশ্যে আসে। বর্তমানে পেগাসাস সবচেয়ে পরিশীলিত হ্যাকিং সফটওয়্যার।
ইসরায়েলের বিরোধিতা
জন যগবি-র ভাষায়, ‘আমরা বেশ কিছুদিন ধরেই আমেরিকাতে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন ক্রমাগত বাড়তে দেখছি। তবে এটি তত বড় কোনও ইস্যু হয়নি। কিন্তু এখন এটি বড় ইস্যু হয়ে উঠছে, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাট শিবিরে। এর পেছনের শক্তি হচ্ছে অশ্বেতাঙ্গ এবং তরুণ প্রজন্মের ভোটাররা এবং দলের প্রগতিশীল অংশ।’
জরিপ সংস্থা পিউ ফাউন্ডেশন স্টাডি বলছে, ২০২১ সালের নির্বাচনে প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে নির্বাচিত সদস্যদের ২৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ, হিসপানিক, এশীয় এবং আদি আমেরিকান বংশোদ্ভূত। এটি একটি রেকর্ড। ২০ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। ১৯৪৫ সালে ছিল মাত্র এক শতাংশ।
আইনসভায় প্রতিনিধিত্বে এই বৈচিত্র্যের কারণে বিভিন্ন ইস্যুতে মতামতের ভিন্নতা বাড়ছে এবং ক্ষমতা ও প্রভাবের ভরকেন্দ্র পাল্টে যাচ্ছে।
কংগ্রেসে তরুণ, প্রগতিশীল কয়েকজন সদস্যের একটি জোট- যেটি স্কোয়াড নামে পরিচিতি পেয়েছে; তার মধ্যে রয়েছেন মিশিগান থেকে নির্বাচিত ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত রাশিদা তালিব এবং মিনেসোটা থেকে নির্বাচিত সোমালিয়ান বংশোদ্ভূত ইলহান ওমর।
এই স্কোয়াডের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত মুখ নিউ ইয়র্ক থেকে নির্বাচিত আলেকজান্ডার ওকাসিও কর্টেজ যিনি প্রাইমারিতে সিনিয়র ডেমোক্র্যাট জো ক্রাউলিকে হারিয়ে দলের টিকিট পেয়ে জিতেছেন।
জো ক্রাউলি ছিলেন ইসরায়েলের কড়া একজন সমর্থক। ফলে, এখন নিউ ইয়র্কের ডেমোক্র্যাটদের ভোটারদের যে প্রোফাইল তার সঙ্গে ৩১ বছরের ওকাসিও-কর্টেজ ৫৯ বছরের ক্রাউলির চেয়ে অনেক বেশি খাপ খান।
জনমত জরিপকারী জন যগবি বলেন, ‘ডেমোক্র্যাট শিবিরে এখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় অশ্বেতাঙ্গ রয়েছেন যারা অন্য অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি আচরণ নিয়ে অনেক বেশি স্পর্শকাতর। তারা ইসরায়েলকে একটি আগ্রাসী শক্তি হিসেবে দেখে।’
সূত্র মতে, চলতি বছর ৪২০ সদস্যের যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে ইসিরাইলকে ১ বিলিয়ন ডলার অনুদানের যে বিলটি উত্থাপন করা হয়েছিল, তাতে মাত্র ৯ জন সদস্য ভেটো দেন।
শুধু তাই নয়, রাতারাতি ইসরায়েলকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার ঘটনাকে লজ্জাজনক বলে উল্লেখ করেন ইলিয়ন অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের নারী সদস্য ম্যারি নিউম্যান।
ম্যারি নিউম্যান বলেন, মার্কিন অর্থে কেনা অস্ত্রে তারা প্রতিনিয়ত নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী অপরাধ খতিয়ে না দেখে এভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ অনুমোদন দেওয়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে ইহুদিবাদী দেশটি।
প্রসঙ্গত, ইসরায়েলকে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আয়রন ডোমের ত্রুটি সারাতে গত সপ্তাহে জরুরিভিত্তিতে ওই অর্থ বরাদ্দের আনুমোদন দেয় মার্কিন কংগ্রেস।
ইসরায়েলের কাছ থেকে মার্কিন সিনেটদের আর্থিক সুবিধা নেওয়ার ঘটনারও নিন্দা জানান ম্যারি নিউম্যান।
এদিকে, চলতি বছরের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করায় ইহুদিবাদী ইসরায়েলের বর্বর আচরণের নিন্দা জানান মার্কিন সংসদ সদস্যরা।
বর্ণবাদী ও বর্বর আচরণের জন্য ডেমোক্র্যাট দলের এমপি বেটি ম্যাককুলামের নেতৃত্বে একদল মার্কিন এমপি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংসদে নিন্দা প্রস্তাব আনে।
বলা হয়েছে, তেলআবিব এবার ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কণ্ঠরোধ করে তাদের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে। ইসরায়েলের হামলা-মামলা উপেক্ষা করে সংগঠনগুলো ফিলিস্তিনিদের চালানো ইসরায়েলি নৃশংসতার চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। ইসরায়েলকে প্রতি বছর ৩.৮ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণে তাদের কর্মকাণ্ডকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে চান মার্কিন এমপিরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশ নীতিতে, বিশেষ করে আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে জনমতের এই প্রতিফলন এখনও তেমন নেই। জো বাইডেন এখনও বিষয়টিকে ততটা গ্রাহ্য করছেন না। কিন্তু ডেমোক্র্যাট শিবিরের ইসরায়েলি সমর্থকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন। তারা ভয় পাচ্ছেন, বহু বছর ধরে জনকল্যাণের ইস্যুতে বাইডেনের যে গ্রহণযোগ্যতা তা নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। আর রাজনীতিকরা তদের সমর্থকদের বেশিদিন অবজ্ঞা করে টিকে থাকতে পারেন না।
এসডব্লিউ/এসএস/১২১২
আপনার মতামত জানানঃ