নওগাঁর পোরশা উপজেলায় দুইটি গ্রামে এক রাতে পাঁচটি মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর করেছে অজ্ঞাত হামলাকারীরা। সোমবার রাতে শরিওয়ালা ও ভবানীপুর গ্রামে এই ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছে।
ভবানীপুরের কালী মন্দিরে একটি, সন্যাস মন্দিরে তিনটি ও মনসা মন্দিরে একটি এবং শরিওয়ালা গ্রামের লক্ষ্মী মন্দিরে দুইটি ও মনসা মন্দিরে একটি প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে।
খবর শুনে গতকাল মঙ্গলবার সকালেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নাজমুল হামিদ রেজাসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করন। নাজমুল হামিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, এই ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করতে ব্যাপক তদন্ত শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে তারা ঘটনার সত্যতা পেয়েছেন এবং এখন এর জন্য জড়িতদের চিহ্নিত করতে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবাই কাজ করে যাচ্ছে।
উপজেলা প্রশাসন বলছে, মন্দিরগুলোতে ঢুকে প্রতিমা ভাংচুরের এমন ঘটনা ওই অঞ্চলে অনেকটাই নজিরবিহীন। তবে, এ ঘটনাটি এমন সময় ঘটল যখন সারা দেশের প্রশাসন ও পুলিশ গত ১৩ই অক্টোবর কুমিল্লায় একটি মন্দিরে কোরআন পাওয়ার পর সারাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির মণ্ডপ ও বাড়িঘরে দুর্গাপূজার সময় যে হামলা হয়েছে তার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা হতাশ ও বিভ্রান্ত
সরকার থেকে দফায় দফায় হিন্দু সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করে তাদের পাশে থাকা এবং হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই।
পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি কাজল দেবনাথ বলছেন, সরকার যা বলছে আর মাঠে যা হচ্ছে তাতে তারা রীতিমত হতাশ ও বিভ্রান্ত।
তিনি বলেন, দুর্গাপূজার সময় যে সহিংসতা হয়েছে তা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিবৃতি দিয়েছিল, সেটি তাদের বিস্মিত করেছিল এবং তাদের প্রতিবাদের পরেও সেটিই এখন বিদেশি মিশনগুলোতে দেয়া হচ্ছে।
কাজল দেবনাথ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে বিবৃতির কথা উল্লেখ করেছেন তাতে মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় যে, সরকারকে বিব্রত করতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মৃত্যু ও ধর্ষণের গল্প ছড়ানো হচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতিতে দাবি করেছিলেন যে সহিংসতায় যে দুজন হিন্দুর মৃত্যু হয়েছে তাদের একজনের স্বাভাবিক মৃত্যু আর অন্যজন পানিতে ডুবে মারা গেছেন। তবে এ বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করে এর তীব্র সমালোচনা করেন হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা।
সাম্প্রতিক ঘটনা প্রসঙ্গে পোরশা উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সভাপতি সুদেব সাহা বলেন, রাতে ভবানীপুর গ্রামে কোনো এক সময় তিনটি মন্দিরে ভাংচুর করে দুর্বৃত্তরা। মন্দিরগুলোতে কালী, শিব, লক্ষ্মীসহ কয়েকটি প্রতিমা ভাংচুর করা হয়। সকালে ঘটনাটি নিশ্চিত হওয়ার পর থানায় জানানো হয়েছে। এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে তিনি জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
ভবানীপুর গ্রামের বাসিন্দা গৌতুম কুমার বলেন, “পাশাপাশি দুটি গ্রামের পাঁচটি মন্দিরের আটটি প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে। কে বা কারা করেছে জানি না। যারাই এই ঘটনার সাথে জড়িত থাক না কেন তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও আইনের আওতায় আনার জোড় দাবি জানাচ্ছি।”
পুলিশের বক্তব্য
পোরশা থানার ওসি শফিউল আজম খান বলেন, ভবানীপুর ও শরিওয়ালা গ্রামের পাঁচটি মন্দিরে হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে। আমরা দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ঘটনাটির সাথে যারাই জড়িত থাকুক তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে।
পোরশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাজমুল হামিদ রেজা বলেন, “ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
নওগাঁর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) গাজিউর রহমান বলেন, ঘটনা জানার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জড়িতদের দ্রুত সময়ের মধ্যে আইন এর আওতায় আনা হবে। কোনোক্রমেই এসব ঘটনার আসামিদেরকে ছাড় দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যেই পুলিশ তদন্ত কাজ শুরু করেছে।
তিনি আরও জানান, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে একটা দুষ্টচক্র যারা সর্বদাই স্বাধীনতার বিরোধিতা করে এসেছে, তারাই বিভিন্নভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এরকম ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে এই দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জোর পুলিশী তৎপরতা চলছে।
মাছের মায়ের পুত্র শোক
প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের নানা পর্যায় থেকে হিন্দুদের আশ্বস্ত করা হলেও হামলা বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন বলছেন, ”নওগাঁর ঘটনাও আগের হামলাকারী চক্রেরই কাজ যারা এখন বিচ্ছিন্নভাবে হামলার কৌশল নিয়েছে”।
তিনি বলেন, বিএনপি ও জামায়াত ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে নাশকতার পরিকল্পনা করছে যা সরকার কঠোরভাবে দমনের চেষ্টা করছে।
যদিও বিএনপি প্রথম থেকেই এ ধরণের ঘটনার জন্য সরকারকে দায়ী করছে ও নিজেদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
এদিকে সম্প্রতি নোয়াখালীর চৌমুহনীতে হামলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সহায়তা দেয়ার এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি সম্পৃক্ত হয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও সাম্প্রতিক সহিংসতার জন্য সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও বিএনপিকে দায়ী করেছেন।
তবে একই সাথে তিনি কেন তার দলের স্থানীয় নেতারা হামলার সময় হিন্দুদের পাশে না দাঁড়িয়ে নীরব ছিলেন তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি বলেন, “এতগুলো মণ্ডপ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিলো চৌমুহনীতে আপনারা কি নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন? একটা প্রতিরোধও তো হলো না। এটা আমাকে দু:খ দিয়েছে। নোয়াখালীর সন্তান হিসেবে আমি নিজে লজ্জা পেয়েছি। কী জবাব দেব আজ হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে?”
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩৭
আপনার মতামত জানানঃ