করোনার প্রভাবে স্বাভাবিকের তুলনায় কি মানসিক রোগগ্রস্তরা বেশি সমস্যায় পড়ছেন? সাম্প্রতিক গবেষণা কিন্তু তেমনটাই বলছে। এমন কি মানসিকভাবে সুস্থদের থেকে তাদের আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুর আশঙ্কাও বেশি বলে জানা গেছে।
মানসিক স্বাস্থ্যজনিত জটিলতায় ভোগা যে কোনো বয়সের মানুষের কোভিড আক্রান্ত হলে ঝুঁকি বেশি থাকে এমন প্রমাণ পাওয়ায় গেছে। পিয়ার রিভিউড জার্নাল জামা সাইকিয়াট্রিতে এ মাসে প্রকাশিত একটি মেটা অ্যানালাইসিসে দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের মুড ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত থাকার সঙ্গে কোভিডজনিত গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর সংযোগ আছে।
তাই যে সব স্বাস্থ্যগত জটিলতা থাকলে কোভিডজনিত গুরুতর অসুস্থতার ঝুঁকি বেড়ে যায়, সে তালিকায় নতুন করে বিভিন্ন ধরনের মুড ডিজঅর্ডার যোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)।
এ কারণে ডিপ্রেশন ও সিজোফ্রেনিয়া স্পেকট্রামের রোগে আক্রান্ত লাখ লাখ আমেরিকানকে ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র মতে, এ বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের কোভিডজনিত মৃত্যুর সম্ভাবনা তিনগুণ বেশি। যদিও মুড ও এংজাইটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্তদের আলাদা মৃত্যুঝুঁকি নেই বলা হয় গবেষণাটিতে।
গত ১৪ অক্টোবর ঝুঁকির কারণেই তালিকায় নতুন এই সংযোজন এনেছে সিডিসি। এর মাধ্যমে দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, মাদকাসক্তির সঙ্গে যে সব পূর্ববর্তী স্বাস্থ্যগত জটিলতার কারণে কোভিডজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে যায়, সে তালিকায় যুক্ত হলো মানসিক স্বাস্থ্য জটিলতা।
দীর্ঘমেয়াদি মানসিক স্বাস্থ্যগত জটিলতা থাকলে সেই ব্যক্তি শারীরিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েন, বেড়ে যায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও। একারণে মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গের গুরুতর কোভিডের সংযোগ খুঁজেছেন গবেষকরা।
ন্যাশনাল এলায়েন্স অন মেন্টাল ইলনেসের অ্যাসোসিয়েট মেডিক্যাল ডিরেক্টর ক্রিস্টাইন ক্রাফোর্ড বলেন, “ডিপ্রেশনের মতো অসুস্থতাগুলোর কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর ঝড় বয়ে যায়। এ কারণে অতিরিক্ত ঝুঁকিতে থাকেন তারা।
ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে ডিপ্রেশনে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ৫ কোটি ৩০ লাখ।
জামা সাইকিয়াট্রির সাম্প্রতিক এ গবেষণাটির একজন গবেষক রজার ম্যাকলানটাইর বলেন, “ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষের ব্যাপারে আমাদের অতি সতর্ক থাকার কারণ আছে। ভ্যাকসিন নিতে তাদেরও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ।”
২০২০ সালে ল্যানসেট সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছিল, কোভিডের ক্ষেত্রে একটি আলাদা ঝুঁকির কারণ হতে পারে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত জটিলতা।
ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণাটির প্রধান গবেষক ড. ম্যাক্সিক ট্যাকেট নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, “এটি শুধু কোভিড আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় না, কোভিডের গুরুতর অসুস্থতার প্রকোপও বেড়ে যায় এর ফলে।”
এই গবেষণা থেকে জানা যায়, ২২টি দেশে এই সংক্রান্ত ৩৩টি গবেষণা চালানো হয়েছিল। গবেষণা করেছিল ইউরোপিয়ান কলেজ অগ নিউরোসাইকোফার্মাকোলজি-র তরফে। সেখান একদিকে যেমন ১৪ লক্ষ ৬৯ হাজার ৭৩১ জন করোনা আক্রান্তের ওপর সমীক্ষা করা হয়, অন্য দিকে পরীক্ষা করা হয় মানসিক রোগে আক্রান্ত ৪৩ হাজার ৯৩৮ জনের ওপর। পরীক্ষা চলে আইসিইউতে ভর্তি রোগীদের ওপরেও।
গবেষণা মতে, মানসিক রোগীদের মধ্যে অনেক বেশি গতিতে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে যাদের অ্যান্টিসাইকোটিক্স ওষুধ দেওয়া হচ্ছে তাদের মৃত্যুহার বেড়ে যাচ্ছে। মানসিক রোগীদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হারও অনেকটাই বেশি বলে জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ এখন বৈশ্বিক মহামারি। যেকোনো বৈশ্বিক মহামারির প্রভাব কেবল সেই রোগের সংক্রমণ, চিকিৎসা আর প্রতিরোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বৈশ্বিক মহামারি পরিবর্তন করে মানুষের মনোজগৎ। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনেও এর ঢেউ এসে পড়ে।
এ সময় রোগ সংক্রমণ আর অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ভয় থেকে মৃত্যুভীতি, অবসাদে ভোগা, উদ্বিগ্ন হওয়া, হঠাৎ রেগে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক থেকে মনের ওপর তৈরি হয় বাড়তি চাপ। অতিরিক্ত মানসিক চাপ ব্যক্তিগত রোগপ্রতিরোধকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং সামষ্টিক প্রতিরোধের ধাপগুলোকেও দুর্বল করে দেবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ