বিশ্বের অন্যতম সুপেয় পানির আধার বাংলাদেশে এখন পানিই বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের উপকূলীয় এলাকার ২০ শতাংশ নারী লবণাক্ততার কারণে অকালগর্ভপাতের শিকার হন। গর্ভাবস্থায় এসব নারী লবণাক্ত পানি পান করেন। এতে তাঁদের খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপ হয়। দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় এখানকার নারীদের গর্ভাবস্থায় সন্তান বেশি মারা যায়। শুধু তাই নয়, লবণাক্ততার কারণে দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় উপকূলের মানুষের মৃত্যুহারও বেশি; বিশেষ করে শিশুদের মৃত্যু এখানে বেশি হয়।
উপকূলীয় এলাকার পরিস্থিতি
উল্লেখ্য, ফাইলাপাড়া গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মী এবং ভুক্তভোগীরা জানায় অধিকাংশ নারীরই গর্ভের বাচ্চা মারা যায় ভ্রূণের বয়স ৬ মাস হবার আগেই৷ তবে এ বিষয়ে কেউ কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না৷
চট্টগ্রামের চকরিয়া উপজেলার ফাইলাপাড়া গ্রামের নারীরা তাদের গর্ভের সন্তান নষ্ট হবার বিষয়টি স্বীকার করলেও কেউই জানেন না কেন এমন হচ্ছে৷ মাটি ও পানিতে অতিরিক্ত লবণের উপস্থিতি এবং তার প্রভাবের বিষয়টি জানার পর অনেকেই অবাক হয়ে যান৷
চকরিয়ার নিকটবর্তী একাধিক গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, এখানকার পুরুষদের অধিকাংশই লবণের ব্যবসার সাথে জড়িত৷ শুকনো মৌসুমে তারা লবণ সংগ্রহ ও বিক্রি করেন৷ প্রতি মণ অপরিশোধিত লবণ বিক্রি হয় ৫০০-৬০০ টাকার মধ্যে৷ যারা লবণের ব্যবসা করেন না, তারা শহরে গিয়ে অন্য কিছু করেন৷
ফাইলাপাড়া, মানিকপাড়াসহ চকরিয়া উপজেলার অন্যান্য গ্রামগুলোর বিভিন্ন শুকনো জায়গাতেও সাদা প্রলেপ দেখতে পাওয়া যায়৷ এ সম্পর্কে জানতে চাইলে একজন গ্রামবাসী বলেন, এগুলো লবণের ভাব৷ কোথাও পানি উঠলে তা নেমে যাওয়ার পর এরকম সাদা হয়ে থাকে৷
প্রসঙ্গত, সাধারণত একজন সুস্থ মানুষ দিনে ৫ গ্রাম লবণ খেলেও এখানকার মানুষেরা খায় ১৬ গ্রাম৷ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা থেকে যারা ২০ কিলোমিটার দূরে থাকেন, তাদের চেয়ে এখানে গর্ভের বাচ্চা মারা যাওয়ার হার দেড় গুণ বেশি যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে৷ দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা খুলনা, সুন্দরবনেও এর ব্যতিক্রম হবার সম্ভাবনা নেই৷
ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগ
৩২ বছর বয়সী সেনোয়ারা বেগমের আড়াই মাস বয়সী গর্ভের শিশু নষ্ট হয় এক বছর আগে৷ সাত মাস হলো তিনি পুনরায় গর্ভধারণ করেছেন৷ এখন পর্যন্ত গর্ভের বাচ্চা সুস্থ থাকলেও অজানা আশঙ্কা কাজ করছে বলে জানান তিনি৷
দুই কন্যা সন্তানের মা রাজিয়া বেগমের গর্ভের বাচ্চা মারা গেছে সাতবার৷ আক্ষেপ করে তিনি বলেন, স্বামী ক্যানসারের রোগী, এতবার গর্ভের বাচ্চা নষ্ট হওয়া এবং বারবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ছাড়া কিছুই না৷
চকরিয়ার মানিকপাড়া গ্রামের ২২ বছর বয়সী মায়মুনা জান্নাতের এ পর্যন্ত গর্ভের সন্তান মারা গেছে দুইবার৷ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি জানার পর তিনি বলেন, এই এলাকায় তাদের বসত ভিটা৷ এটি ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নেওয়ার মতো বিত্তবান তারা নন৷ যত সমস্যাই থাকুক, এখানেই তাদের থাকতে হবে৷
৪০ বছর বয়সী উম্মে হাবিবার গর্ভের বাচ্চা নষ্ট হয় দুই বছর আগে৷ মাটি এবং পানিতে অতিরিক্ত লবণের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ২৫-৩০ বছর আগেও এখানকার জমিগুলো অনেক উর্বর ছিল৷ কিন্তু এখন আর তেমন কোন ফসল না ফলায় অনেকেই কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়েছেন৷ সামগ্রিক বিষয়ে তিনি সরকারের সুদৃষ্টি আশা করেন৷
চকরিয়ার মানিকপাড়া গ্রামের সানোয়ারা বেগমের দুইটি সন্তানের মধ্যে শেষ সন্তানটি গর্ভে মারা যায় ১১ বছর আগে৷ তিনি বলেন, অনেকেরই তো শুনি বাচ্চা পেটে মারা যাইতেসে, কিন্তু এর পিছে যে এই কারণ সেটা তো আন্দাজ করতে পারি নাই৷ আমরা ভাবসি, আল্লাহ্র হুকুম হইসে, বাচ্চা পেটেই মারা যাইতেসে৷
মানিকপাড়া গ্রামের রোমানা বেগমের প্রথম সন্তানটিই গর্ভে থাকাকালীন মারা যায় তিন বছর আগে৷ আল্ট্রসনোগ্রাম করার মাধ্যমে তিনি বিষয়টি চিকিৎসকের কাছে জানতে পারেন৷ প্রথম সন্তানটি গর্ভে মারা যাওয়ায় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে কটু কথা শুনতে হয় বলে তিনি জানান৷
কেন হচ্ছে এই অকালগর্ভপাত?
মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এসবে সামান্য একটি পরিবর্তন সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দিতে পারে। যখন সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ে, তখন লোনা পানি নদী এবং ওপরের স্রোতের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে, একসময় যা মাটিতে মিশে যায়। এমনকি এটি মাটির নীচের পানির সঙ্গেও মিশে যায় এবং পরিষ্কার পানিকে দূষিত করে তোলে। কুয়া বা নলকূপের মাধ্যমে সেই পানি পান করেন গ্রামবাসীরা।
উপকূলীয় কিছু গ্রামের নলকূপ থেকে যে পানি বের হয়, তা খানিকটা লালচে ধরণের, লবণাক্ত। কিন্তু এই পানি খাওয়া ছাড়া, গোছল বা রান্নাবান্নায় ব্যবহার করা ছাড়া গ্রামবাসীর আর কোন বিকল্প নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, কোন ব্যক্তির প্রতিদিন ৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত না। কিন্তু চকোরিয়ায় উপকূলীয় এলাকার মানুষজনকে প্রতিদিন ১৬ গ্রাম লবণ খেতে হচ্ছে, যা পাহাড়ি এলাকার মানুষজনের তিনগুণ বেশি।
যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলোয় অনেক বছর ধরে লবণ খাওয়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছেন অধিকার কর্মীরা। এর ফলে হাইপার টেনশন, স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি, হার্ট অ্যাটাক, গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকির কথা বলেছেন। কিন্তু এই বাংলাদেশি পরিবারগুলোর কোন ধারণা নেই, পানির কারণে তারা কতটা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন। যদি তা তাদের জানাও থাকতো, তাদের সামনে কোন বিকল্পও নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। ২০০৫ সালের সুনামির পর অনেক এলাকায় কৃষি জমি ও পরিষ্কার পানি নষ্ট হয়ে গেছে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে ফ্লোরিডায় পরিষ্কার পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু চকোরিয়ায় মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব দেখা যাচ্ছে, তা বেশ অভিনব।
পানির সংকটে বাংলাদেশ
বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকাশিত ‘মান অজানা: পানির অদৃশ্য সংকট’ শীর্ষক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পানির সমস্যার বিষয়টি উঠে আসে। তাতে বলা হয়, লবণাক্ততার কারণে প্রতিবছর বিশ্বের ১৭ কোটি মানুষের প্রয়োজনের সমপরিমাণ খাদ্য উৎপাদন কম হয়।
শুধু লবণাক্ততাই নয়, বিশ্বজুড়ে পানির নতুন বিপদ হিসেবে অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার সমস্যাকে সামনে আনা হয়েছে। একই সঙ্গে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আর্সেনিকের কারণে পানিদূষণের বিষয়টি উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, এসব সমস্যা বিশ্বের সুপেয় পানির উৎসগুলোকে বিষিয়ে তুলছে।
বিশ্বের অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার বিপদের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মোড়ক ও পানিয়র পাত্র হিসেবে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। এসব প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। প্লাস্টিকের অতি ক্ষুদ্র কণা পানির সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করে ক্যানসার থেকে শুরু করে নানা রোগব্যাধি তৈরি করছে।
বিশ্বব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের ৮০ শতাংশ সুপেয় পানি, ট্যাপের পানির ৮১ শতাংশ ও বোতলজাত পানির ৯৩ শতাংশ ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার দূষণের শিকার। বাংলাদেশেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
পানিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইড বাংলাদেশ’র কান্ট্রি ডিরেক্টর খায়রুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে লবণাক্ততা একটি বড় সমস্যা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। এ সমস্যা যে হারে বাড়ছে, তার সমাধানের উদ্যোগ সেই হারে এগোচ্ছে না। উপকূলীয় এলাকায় বেশি করে মিষ্টিপানির পুকুর খনন থেকে শুরু করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার উদ্যোগের ওপর গুরুত্ব দেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ১২ শতাংশ মানুষ এখনো আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে। আর গড়ে উপকূলের ৩ শতাংশ শিশু লবণাক্ততার কারণে মারা যায়। এই হার বরিশাল বিভাগে প্রায় ২০ শতাংশ। এসব এলাকার নারীরা প্রতিদিন গড়ে ২০ কিলোমিটার দূর থেকে মিষ্টিপানি সংগ্রহ করে। এতে তাদের নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ