দেশের গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে স্বাধীন গণমাধ্যম অপরিহার্য বলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি আলোচনা সভায় উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্টজনেরা। একইসাথে সরকার, রাজনৈতিক দল, বিশেষ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত হওয়া ছাড়া স্বাধীন গণমাধ্যম নিশ্চিত সম্ভব নয় বলেও মত দিয়েছেন তারা।
দেশের মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত ‘৫০ বছরের বাংলাদেশ: গণমাধ্যমের অর্জন ও আগামীর চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা। সংগঠনের সভাপতি ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের সভাপতিত্বে আজ শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।
গণমাধ্যম ও নাগরিকের স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে এই সময়ের বড় বাধা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাসহ সকল প্রকার নিবর্তনমূলক আইন বাতিলের দাবিও জানানো হয় আলোচনা সভায়। একইসঙ্গে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তথ্য কমিশন, প্রেস ইন্সটিটিউট ও প্রেস কাউন্সিল কার্যকর করতে সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানানো হয়।
সংবাদপত্রের অর্জন ও চ্যালেঞ্জের বিষয়ে বিষদ আলোচনায় অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “কোনো ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব সংবাদপত্রের নয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দেশের সংবাদপত্রগুলোকে জনস্বার্থ, ন্যায়বিচার, সুশিক্ষা, পরিবেশ, নারী সুরক্ষা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার মতো বিষয়গুলোতে সচেতনতা তৈরির কাজ চালিয়ে যেতে হবে।”
তিনি বলেন, “দেশের গণ্যমাধ্যম এখনো শিল্প হিসেবে দাঁড়ায়নি, দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। বিদেশী গণমাধ্যমগুলোর তুলনায় অনেক কম বেতন-ভাতা ও সুযোগ দেয় বাংলাদেশের গণমাধ্যম। তারপরও তরুণরাই বেশি ঝুঁকছে সাংবাদিকতার পেশার দিকে।”
তিনি বলেন, “অর্জন বড় হয় যখন সীমাবদ্ধতা বেশি থাকে। সে বিচারে বাংলাদেশে সংবাদপত্রগুলোর অর্জন অনেক বড়। তারপরেও এ দেশের সংবাদপত্রগুলো সত্য প্রকাশে কতটা বস্তুনিষ্ঠ তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।”
তিনি বলেন, সাংবাদিকদের বিভাজন ও দলীয় রাজনৈতিক প্রীতি থেকে বেরিয়ে আসাসহ নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যেন সবার এর প্রতি আস্থা তৈরি হয়। হলুদ রঙ যেন সাংবাদিকতার পেশাকে না ধরে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে মাহফুজ আনাম বলেন, জনগণের সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করা হলেও আইনের বেশ কিছু বিতর্কিত ধারার অপপ্রয়োগ করে গণমাধ্যমর কর্মীদের হয়রানি করার অভিযোগ বেশি।
তিনি বলেন, “আইনটি প্রণয়নের সময় সম্পাদক পরিষদ যে মতামত দিয়েছিল তা গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়াও বিৃটিশ আমলে প্রণীত অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, তথ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নের পর অটোমেটিক বাতিল বলে গণ্য হবে। সেটির প্রয়োগ এখনো রয়েছে।”
তিনি বলেন, “মানহানির মামলার ক্ষেত্রে আইনে স্পষ্ট আছে যে একটি ঘটনা কেন্দ্র করে কেবল একটি মামলাই হতে পারে। একমাত্র সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মামলা করতে পারেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, একই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বাইরে অনেকেই মামলা করেছেন।”
সাংবাদিকতার বিকাশের ক্ষেত্রে বিচারবিভাগ, বিশেষ করে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের কাছে মাহফুজ আনাম অনুরোধ রেখে বলেন, “আপনারা মেহেরবানি করে একটু দেখুন, কিছু কিছু আইন আছে সেগুলো কীভাবে প্রয়োগ হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “সংবিধানে মাত্র দুইটি পেশার নাম উল্লেখ করে তাদেরকে সুরক্ষার বিধান রয়েছে। একটি হলো জুডিশিয়ারি অপরটি গণমাধ্যম। সমাজ তার বিকাশ, বিবর্তন, উন্নয়নসহ সমস্ত অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রয়োজন। তাই এই বিধান রয়েছে সংবিধানে।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারা, অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট বাতিলের দাবি জানান মাহফুজ আনাম। সংবাপত্রের মালিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, “আপনি যখন অন্য কোনো প্রডাক্ট উৎপাদন করছেন, সেখানে সঠিকভাবে মান নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু গণমাধ্যমের মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সেটি হয় না। এতে করে আপনার অন্য প্রডাক্ট মানহীন হলে যেরকম বাজার নষ্ট হয়, পত্রিকার ক্ষেত্রে সেটিই হবে।”
অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান বলেন, “সাংবাদিকদের মধ্যে কোনো বিভাজন থাকা উচিত না। সাংবাদিকতা করতে এসে কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখা যাবে না। এছাড়াও সাংবিদকদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে প্রশিক্ষণের বিষয়ে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।”
নুরুল কবীর বলেন, “স্বাধীন ৫০ বছরে দেশের সাংবাদিকতাকে লড়াই করে চলতে হয়েছে। ৯০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আমাদের সংবাদমাধ্যমে তুলনামূলক একটু ভালো সময় গেছে।”
আলোচনা সভায় ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত শ্যামল দত্ত বলেন, “কর্তৃত্ববাদী শাসন চললে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অসম্ভব। গণমাধ্যম মনিটরিং ও সরক্ষার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো পুরোই অকার্যকর।” এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন?
বাংলাদেশে গণমাধ্যম কিংবা এর কর্মীরা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক বেশ পুরনো। ২০২১ সালে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানে ১৮০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এর আগের বছরের তুলনায় ছয় ধাপ নেমে ১৫২ তে দাঁড়িয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র মতে, বাংলাদেশে করোনাকালে ‘বিতর্কিত’ ডিজিটাল আইনের মামলার সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সাংবাদিকরাই এর প্রধান টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন পুলিশ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। আইন বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, করোনায় সরকার ব্যর্থতা ঢাকতেই সাংবাদিক ও নাগরিকদের মুখ বন্ধ করার জন্য এই আইনটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্রিটিশ সংস্থা ‘আর্টিকেল ১৯’ এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, “করোনা সামাল দিতে পারছেনা, ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে, পুলিশে ঘুষের ঘটনা ঘটছে। মানুষ তা নিয়ে কথা বলছে। আর তা ঠেকাতে নানা অজুহাতে ডিজিটাল আইনে মামলা হচ্ছে।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাইবার ট্রাইব্যুনালে তিন বছরে ৪৬৫৭টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ৯২৫টি, ২০১৯ সালে এক হাজার ১৮৯টি ও ২০২০ সালে এক হাজার ১২৮টি এবং চলতি বছর ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেড় হাজারে বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামিদের মধ্যে বেশিরভাগই রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভিন্ন মতের বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহার করেছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম নয় মাসের (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২১) মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনা পর্যালোচনা করে সাংবাদিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে আসক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত নয় মাসে ১৫৪ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এক সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাও গেছেন। হামলা-মামলা-হুমকি তো আছেই। এছাড়া আসক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুসহ নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্রও তুলে ধরেছে তাদের প্রতিবেদনে।
সেল্ফ সেন্সরশিপ
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সাথে জড়িতদের অনেকে স্বীকার করছেন, সেলফ সেন্সরশিপ, অর্থাৎ নিজেরাই খবর চেপে যাওয়া বা প্রকাশ না করার ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্ন উঠলে সাধারণত সরকারের নানা কালো আইন, বিধিনিষেধ বা চাপের প্রতি ইঙ্গিত করেন অনেকে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা উল্লেখ করা হয়।
তবে বাংলাদেশের সম্পাদক এবং সাংবাদিকরা স্বীকার করছেন, গণমাধ্যমে বিগত দশকগুলোতে যে ধরণের পুঁজির লগ্নি হয়েছে, তাতে করে মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে এবং সাংবাদিকতার নয়, মালিকের স্বাধীনতার নিশ্চিত হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের মূল ধারার গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থার সংকটের অভিযোগ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম গণমাধ্যমে সেলফ সেন্সরশিপের প্রবণতা বৃদ্ধির পেছনে বড় কারণ হিসাবে দেখেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে। তিনি বলেন, “সামগ্রিকভাবে আমাদের পেশাটা একটুখানি হুমকির মুখে। তারপর এই যে কোভিড এবং ডিজিটাল যে ট্রানজিশন-সব মিলিয়ে প্রিন্ট মিডিয়া বেশ কিছুভাবে আক্রান্ত বলা যেতে পারে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটা ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। যেখানে সঠিক এবং স্বাধীন সাংবাদিকতা করা অত্যন্ত দুরহ ব্যাপার হয়ে গেছে।”
মানবাধিকার সংস্থার উদ্বেগ
চলতি বছর বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রধানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে আটটি মানবাধিকার সংস্থা৷ তারা চাচ্ছে, বাকস্বাধীনতা রক্ষায় জাতিসংঘের তরফ থেকে উদ্যোগ নেয়া হোক৷
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মিশায়েল ব্যাচলেটকে দেয়া চিঠিতে মানবাধিকার সংস্থাগুলো লিখেছে, ‘‘বাংলাদেশ সরকার ক্রমাগতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে আমরা এ বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি৷’’ মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ হিসেবে চিঠিতে গণমাধ্যম এবং বাকস্বাধীনতা চর্চা করা সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট ও ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর দমনপীড়নের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে৷
জাতিসংঘকে দেয়া এই চিঠিতে স্বাক্ষর করা সংগঠনগুলো হচ্ছে, এশিয়ান ফেডারেশন এগেন্সট ইনভলান্ট্রি ডিজঅ্যাপিয়ারেনসেস, এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস, কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস ও রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস৷
আপনার মতামত জানানঃ