বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক সম্প্রতি সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হচ্ছে বারবার। অভিযোগ রয়েছে, বর্ণবাদী বিদ্বেষ থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় উস্কানিদাতাদের নিজস্ব মতাদর্শ প্রচারের সুযোগ করে দিচ্ছে ফেসবুক। এমনকি অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী মিয়ানমারের উগ্রবাদীদের রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রেক্ষাপট তৈরিতেও ভূমিকা রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানিটি।
ফেসবুক এ নিয়ে শুধু গণমাধ্যমের সমালোচনা, জনরোষের মুখোমুখিই হয়নি। বরং মার্কিন কংগ্রেসের নিজস্ব তদন্তের মুখেও পড়েছে। অতীতেও এসব সংকট একের পর এক মোকাবিলা করেছে ফেসবুক। তবে এবার একসঙ্গে তিনটি সমস্যার মুখোমুখি হতে চলেছে এই জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি। ফলে দীর্ঘ ১৭ বছরের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে তীব্র সংকটে পড়তে যাচ্ছে ফেসবুক।
গত শুক্রবার সিএনএনসহ যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টি গণমাধ্যমের একটি জোট সিলিকন ভ্যালির এই টেক-জায়ান্টটি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করে; যাকে বলা হচ্ছে ‘দ্য ফেসবুক পেপার্স’। এতে কোম্পানির একান্ত অভ্যন্তরীণ পরিচালনার বিবরণসহ মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস) ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে উন্মুক্ত করা তথ্যাবলি রয়েছে। রয়েছে মার্কিন কংগ্রেসকে দেওয়া ফেসবুক হুইসেলব্লোয়ার ফ্রান্সেস হাউগেনের সাক্ষ্যের বিবরণ; যেখানে কোম্পানিটির নীতি কীভাবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতায় মদদদাতাদের সংগঠিত করে, তা তুলে ধরেন হাউগেন।
পাশাপাশি মার্ক জাকারবার্গের বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিরাপত্তা বা সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের চেয়ে নাকি ব্যবসাটাই তার কাছে বড়। এজন্যই বাকস্বাধীনতার পক্ষের লোক হয়েও তিনি যোগসাজশ করেছেন ভিয়েতনাম সরকারের সাথে। সমাজতান্ত্রিক সরকার-শাসিত সেই দেশটির চাওয়া ছিল, সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড যেন ‘সেন্সর’ করে ফেসবুক। বার্ষিক এক বিলিয়ন দলার রাজস্ব আসে ভিয়েতনাম থেকে। তাই সেই বাজারটি খোয়াতে চাননি তিনি।
সূত্র মতে, গত ৬ জানুয়ারি মার্কিন পার্লামেন্ট ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার নেপথ্যে ফেসবুকে প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একইসাথে, ভারতের সহ বিভিন্ন দেশে ফেসবুকের কন্টেট মডারেশনে ব্যর্থতা এবং কীভাবে মানব পাচারকারী চক্রগুলো এই সাইট ব্যবহার করে মানুষকে শোষণ করছে, সেটিও উঠে এসেছে হাউগেনের সাক্ষ্যে। উল্লেখ্য, ভারতে ফেসবুকের একটি পরীক্ষামূলক ‘ডামি’ অ্যাকাউন্ট থেকে মুসলিম-বিরোধী অসংখ্য গুজব ছড়ানো হয়, যা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত দৃশ্যমান ছিল।
এদিকে, কিছুদিন আগে হাউগেন ফেসবুকের হাজার হাজার গোপন নথি ফাঁস করে দিলে, সেগুলোর উপর ভিত্তি করে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল আরেক প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম- দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল। ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের হাতে আসা নথিকে বলা হয়েছিল ‘ফেসবুক ফাইলস’। এর ভিত্তিতে কিশোরীদের ওপর ইনস্টাগ্রামের মন্দ প্রভাব তুলে ধরা হয় একটি প্রতিবেদন। এর উপর যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটের একটি উপ-কমিটিতে শুনানিও হয়। কমিটির কাছে জবানবন্দি দেন ফ্রান্সেস হাউগেন।
এরপর কমিটির সদস্যরা ফেসবুকের শীর্ষ নির্বাহী ও প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকে সাক্ষ্য দিতে আসতে বলেন। তারপর থেকেই চলা সমালোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে দ্য ফেসবুক পেপার্স। এখানেই শেষ নয়, ফেসবুকের সামনে যেন সংকটের অন্ত নেই। গত শুক্রবার ফেসবুকের আরেক সাবেক কর্মী বেনামে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক কমিশনের কাছে একটি অভিযোগ করেন, যার সঙ্গে মিল রয়েছে হাউগেনের অভিযোগের।
ডেটা প্রাইভেসি বা ব্যবহারকারীর তথ্যের নিরাপত্তা ভঙ্গসহ উগ্র বা মিথ্যা প্রচারমূলক কন্টেট সম্পাদনায় ব্যর্থতার বহু অভিযোগ আগেও মোকাবিলা করেছে ফেসবুক। কিন্তু, এবার এত বেশি পরিমাণ নথি গণমাধ্যমের হাতে এসেছে, যা একে-একে প্রকাশিত হয়ে কোম্পানিটির সামগ্রিক ব্যবসায়ীক মডেলের প্রতিটি দিকে সমস্যাগুলো তুলে ধরছে। ঘৃণামূলক ও মিথ্যে তথ্য প্রচারে বাধাদানে ব্যর্থতাসহ, আন্তর্জাতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে আগ্রাসী নীতি এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরীদের খারাপ প্রভাব থেকে রক্ষায় ব্যর্থতার দিক উঠে আসছে একের পর এক। এসব বিষয় ইঙ্গিত দেয় যে, ফেসবুক তাদের বিশালসংখ্যক ব্যবহারকারী ব্যবস্থাপনার সঠিক গুরুত্বও বোঝেনি।
এতসব বিতর্কেই নাজেহাল ফেসবুক। প্রতিষ্ঠানটির যোগাযোগ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জন পিনে এক টুইট বার্তায় বলেছিলেন, ফেসবুক পেপার্স আসলে লাখ লাখ তথ্যের মধ্যে অল্প কিছু তথ্যের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উপস্থাপন। যা থেকে আসলে সঠিক উপসংহারে আসা সম্ভব নয়।
তিনি আরো জানান, শুধু নিরাপত্তা বিভাগেই কাজ করছে ফেসবুকের প্রায় ৪০ হাজার কর্মী। এছাড়াও ৭০-এর বেশি ভাষায় বিভিন্ন কনটেন্টকে রিভিউয়ের জন্য নিয়োজিত আছে প্রায় ১৫ হাজার কর্মী।
যদিও ফেসবুক বলছে, ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার পেছনে ২০১৬ থেকে এখন পর্যন্ত তারা বিনিয়োগ করেছে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার। অথচ রাজস্ব নয়, কেবল লাভের অঙ্কই ফেসবুকের ২৯ বিলিয়ন ডলার, সেটিও শুধু গত বছরেই।
এদিকে ব্যবহারকারীদের আস্থাহীনতার পাশাপাশি দেখা দিয়েছে কর্মী অসন্তোষও। ফেসবুকের ঊর্ধ্বতনদের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে খুশি নন অনেক কর্মী। এদিকে নিজেদের হারানো ইমেজ পুনরোদ্ধারে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ফেসবুক। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি তাদের ব্র্যান্ড নাম বদলের মতো সিদ্ধান্তও নিয়েছে। ভার্জের সূত্র ধরে রয়টার্স বলছে, ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ আগামী ২৮ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক সম্মেলনে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলবেন।
নিজেদের ১৭ বছরের ইতিহাসে এতটা কোণঠাসা হয়নি ফেসবুক। ফলে প্রশ্ন উঠেছে এর ভবিষ্যত নিয়েই। তবে আশার কথা হলো, হুইসেলব্লোয়ার ফ্রান্সেস হাউগেন বা ফেসবুকের বিরুদ্ধে সরব কোনো সাবেক কর্মীই চান না, বন্ধ হয়ে যাক ফেসবুক। তারা মনে করেন, ফেসবুক চাইলেই তাদের ব্যাপারে তৈরি হওয়া সকল আস্থাহীনতা কাটিয়ে উঠতে পারবে।
কিন্তু সব মিলিয়ে কোম্পানিটির জন্য অস্বস্তিকর বেশ কিছু প্রশ্ন উঠছে; ফেসবুক ইঙ্ক কী তাদের সুবিশাল প্ল্যাটফর্মগুলো সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাস্তব দুনিয়ায় হিংসা বা সংঘাত ঠেকাতে সক্ষম? নাকি ফেসবুক এত বড় ও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে, যে এসব পরোয়া না করেই ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে? প্রসঙ্গত, প্রায় ২৫০ কোটি ব্যবহারকারী ফেসবুক ইঙ্কের হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মতো সাইটে যুক্ত আছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৫৭
আপনার মতামত জানানঃ