সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ২০১৪ সালে ‘বিষাক্ত আংটি’ ব্যবহার করে তৎকালীন বাদশাহ আবদুল্লাহকে খুন করতে চেয়েছিলেন। বাবার জন্য সৌদি আরবের সিংহাসনে আরোহনের পথ পরিষ্কার করতেই তিনি এই খুন করতে চেয়েছিলেন। মার্কিন গণমাধ্যমে যুবরাজের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক এ অভিযোগ করলেন কানাডায় নির্বাসিত দেশটির সাবেক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা সাদ আল-জাবরি। খবর সিবিএসের।
মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিবিএসের সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘৬০ মিনিটস’ -এ সাদ আল-জাবরি এসব কথা বলেন।
সাদ আল-জাবরি বলেন, আমি এমন একটি ভিডিওর কথা জানি, যেখানে বাদশাহ আবদুল্লাহকে চাইলেই খুন করতে পারেন বলে বড়াই করেছিলেন বিন সালমান।
ওই সময় সালমান বলেছিলেন, তার কাছে রাশিয়ার এমন একটি বিষাক্ত আংটি আছে, যা দিয়ে করমর্দন করেই সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহকে খুন করা যায়।
বাবার জন্য সৌদি আরবের সিংহাসনে আরোহনের পথ পরিষ্কার করতেই তিনি এই খুন করতে চান বলে ২০১৪ সালে চাচাতো ভাই বিন নায়েফকে (তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) জানিয়েছিলেন বিন সালমান।
সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে তখন সৌদি শাসক পরিবারের ভেতরে উত্তেজনা চলছিল।
জাবরি বলেন, মোহাম্মদ বিন নায়েফকে তখন যুবরাজ সালমান বলেছিলেন— আমি বাদশাহ আব্দুল্লাহকে হত্যা করতে চাই। রাশিয়া থেকে একটি বিষাক্ত আংটি পেয়েছি। তার সঙ্গে শুধু করমর্দন করলেই তিনি শেষ হয়ে যাবেন।
চার বছর আগে সৌদি আরবের ক্ষমতায় আসা যুবরাজ সালমান সম্পর্কে জাবরি বলেন, দেশের ডি ফ্যাক্টো শাসক এবং বাদশাহ সালমানের ছেলে মধ্যপ্রাচ্যে অসীম সম্পদের অধিকারী। তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ, খুনি, নিজ দেশের জনগণ, আমেরিকা এবং সারাবিশ্বের জন্যই তিনি হুমকি।
তিনি বলেন, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’, ‘তার মধ্যে সহমর্মিতার বোধ বলে কিছু নেই’।তার মতে, সৌদি যুবরাজ ‘বেপরোয়া ও বিশ্বাসঘাতক’।
তিনি বলেন, ‘যুবরাজের মধ্যে আবেগ বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। তিনি পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে কোনো শিক্ষা নেন না।’
দেশের ডি ফ্যাক্টো শাসক এবং বাদশাহ সালমানের ছেলে মধ্যপ্রাচ্যে অসীম সম্পদের অধিকারী। তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ, খুনি, নিজ দেশের জনগণ, আমেরিকা এবং সারাবিশ্বের জন্যই তিনি হুমকি।
এদিকে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগজি খুন হওয়ার পর জাবরি তার এক বন্ধুর কাছ থেকে সতর্কবার্তা পেয়েছিলেন যে, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তাকে হত্যার উদ্যোগ নিয়েছেন। সাক্ষাৎকারে জাবরি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে একটি গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানে কাজ করা তার এক বন্ধু তাকে এ সতর্কবার্তা দিয়েছেলিন। বলেছিলেন যে, ২০১৮ সালের অক্টোবরে তাকে খুন করতে মোহাম্মদ বিন সালমান একটি ‘হিট টিম’ পাঠাচ্ছেন।
সিবিএসের সিক্সটি মিনিটস অনুষ্ঠানে আলজাবেরি জানান, ২০১৮ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে খাশোগজিকে হত্যার পর একটি ঘাতক দল কানাডার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। সে সময় এক সহযোগীর মাধ্যমে আলজাবেরি জানতে পারেন যে ওই দলটি তাকে হত্যা করতে যাচ্ছে।
আলজাবেরি জানান যে তাকে সতর্ক করে ওই সহযোগী বলেছিলেন, ‘কানাডায় কোনো সৌদি কূটনৈতিক মিশনের ধারেকাছে যাবেন না। কনস্যুলেটে যাবেন না, দূতাবাসেও যাবেন না।’
কেন জানতে চাইলে আলজাবেরিকে বলা হয়, ‘ওরা খাশোগজিকে টুকরো টুকরো করেছে, মেরে ফেলেছে। পরবর্তী লক্ষ্য হিসেবে তালিকার শীর্ষে এখন আপনি আছেন।’
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় মামলার অভিযোগপত্রের কল্যাণে কথিত সেই হত্যা পরিকল্পনার কিছু অংশের বিস্তারিত সামনে এসেছে আগেই। সিক্সটি মিনিটস অনুষ্ঠানে দেয়া আলজাবেরি মূলত তুলে ধরেছেন যুবরাজ মোহাম্মদের সঙ্গে তার সম্পর্কচ্ছেদের আদ্যপান্ত।
নিজের সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে আলজাবেরির আকুতিও উঠে আসে সাক্ষাৎকারে। সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট দুই ভাইবোন সারাহ ও ওমর সৌদি আরবে কারাবন্দি। প্রাপ্তবয়স্ক এই দুই সন্তানকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি গত বছর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। অভিযোগ আছে, বাবা আলজাবেরিকে দেশে ফিরতে বাধ্য করার কৌশল হিসেবে সারাহ ও ওমরকে আটকে রেখেছে সৌদি রাজপরিবার।
তিনি বলেন, ‘আমাকে কথা বলতে হবে। আমেরিকান জনগণ আর আমেরিকান প্রশাসনকে অনুরোধ করছি, আমাকে সাহায্য করুন। আমার সন্তানদের মুক্ত করতে ও তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে আপনাদের সহযোগিতা আমার দরকার।’
আলজাবেরির অভিযোগের বিষয়ে এখন পর্যন্ত মুখ খোলেনি সৌদি প্রশাসন। তবে একটি বিবৃতিতে দাবি করেছে, ‘আলজাবেরি একজন নিন্দিত সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। তথ্য অতিরঞ্জিত করার দীর্ঘ ইতিহাস আছে তার। নিজের আর্থিক অপরাধ ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে নজর ঘোরাতে এসব কৌশল অবলম্বন করেন তিনি।’
অভিযোগকারী সাদ আলজাবেরি সাবেক সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ছিলেন। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের পূর্বসূরী ও চাচাতো ভাই মোহাম্মদ বিন নায়েফ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। ২০১৭ সালে তাকে সরিয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানকে যুবরাজ ঘোষণা করেন বাদশাহ সালমান।
বর্তমানে সৌদি আরবে বন্দি জীবনযাপন করছেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ। সৌদি রাজনীতিতে তিনিই যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করা হয়।
আলজাবেরি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, আমার মৃত্যু অবধারিত। কারণ আমাকে মৃত না দেখা পর্যন্ত এই ব্যক্তি (বর্তমান যুবরাজ) থামবে না।’
আলজাবেরির পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো সমর্থন রয়েছে।
২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারসহ বিভিন্ন জায়গায় একযোগে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়। হামলা পরবর্তী সময়ে আমেরিকান ও সৌদি নাগরিকদের প্রাণ বাঁচাতে সহযোগিতার জন্য তৎকালীন সৌদি সরকারকে কৃতিত্ব দেয় সাবেক আমেরিকান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সে সময় সৌদি যুবরাজ ছিলেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ, যার সহযোগী আলজাবেরি।
সিক্সটি মিনিটসে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মাইক মোরেল বলেন, ‘আলজাবেরি মর্যাদার যোগ্য ব্যক্তি।’
মোরেলের মতে, আলজাবেরির দেয়া গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই ২০১০ সালে নিষিদ্ধঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার বোমা হামলার পরিকল্পনা নস্যাৎ করা সম্ভব হয়েছিল। পণ্যবাহী দুটি বিমানে থাকা মালামালের মধ্যে দুটি ডেস্কটপ প্রিন্টারে বোমা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
মোরেল জানান, আরও অনেকবারই আমেরিকানদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন আলজাবেরি। কিন্তু সেসব ঘটনা এখনও গোপন তথ্য হিসেবে শ্রেণিভুক্ত।
কানাডায় আলজাবেরিকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আগে প্রত্যাখ্যান করেছে সৌদি আরব। খাশোগজি হত্যাকাণ্ডেও সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ স্বীকার করেনি দেশটি।
কিন্তু চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক খাশোগজিকে হত্যায় অনুমোদন দিয়েছিলেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নিজে।
এর আগে সাদ আলজাবেরি দাবি করেছিলেন যে বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আব্দুলআজিজ ক্ষমতায় থাকাকালীন তাকেও হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমান।
আলজাবেরির মতে, চাচা বাদশাহ আবদুল্লাহকে হত্যা করে বাবা সালমান বিন আব্দুলআজিজকে সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিলেন মোহাম্মদ।
ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ৯০ বছর বয়সে ২০১৫ সালে মৃত্যু হয় বাদশাহ আবদুল্লাহর। তার উত্তরসূরী হিসেবে সৌদি আরবের পরবর্তী বাদশাহ হন আবদুল্লাহর সৎ ভাই সালমান বিন আব্দুলআজিজ। তাদের পিতা প্রয়াত বাদশাহ আব্দুলআজিজ বিন আব্দুল রহমান।
বর্তমান বাদশাহ সালমানের উত্তরসূরী ও সৌদি আরবের পরবর্তী সম্ভাব্য শাসক তার অষ্টম সন্তান মোহাম্মদ বিন সালমান। কথিত আছে ৮৫ বছর বয়সী বাদশাহ সালমানের ওপর যুবরাজ মোহাম্মদের কর্তৃত্ব আছে এবং সালমান প্রশাসনের সিদ্ধান্তের প্রায় সবটাই যুবরাজের নিয়ন্ত্রণে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪১
আপনার মতামত জানানঃ