ফেসবুকে ‘ধর্মীয় অবমাননার’ কথিত অভিযোগ তুলে রংপুরের পীরগঞ্জে মাঝিপাড়ায় হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনার ‘হোতাদের একজনকে’ গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। পীরগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গ্রেপ্তার সৈকত মণ্ডল ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন বলে জানা গেছে। কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দর্শন বিভাগের কমিটির সহসভাপতি পদে ছিলেন তিনি। পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ার ঘটনার এক দিন পর (১৮ অক্টোবর) তাকে ছাত্রলীগের কমিটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
সৈকত মণ্ডল কারমাইকেল কলেজের দর্শন বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র। তিনি ওই বিভাগে ছাত্রলীগের কমিটির ১ নম্বর সহসভাপতি। ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট ওই কমিটির অনুমোদন দেন কলেজ ছাত্রলীগ কমিটির সভাপতি সাইদুজ্জামান সিজার ও সাধারণ সম্পাদক জাবেদ আহমেদ।
উসকানিমূলক পোস্ট দেওয়া ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার অন্যতম হোতা অভিযোগে সৈকত মন্ডল ও সহযোগী রবিউল ইসলামকে টঙ্গী থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তারের পর শনিবার (২৩ অক্টোবর) র্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে র্যাবের পক্ষ থেকে সৈকত মণ্ডলকে পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ার হিন্দুপল্লীতে সহিংসতার ঘটনায় অন্যতম হোতা হিসেবে দাবি করা হয়।
ঢাকার কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গ্রেপ্তারের তথ্যটি নিশ্চিত করেন।
সাংবাদিকদের খন্দকার আল মঈন বলেন, ফেসবুকে ফলোয়ার প্রায় তিন হাজার। ফলোয়ার আরও বাড়াতে ও ব্যক্তিগত ইমেজকে প্রচার করতেই ‘এ মুহূর্তে গ্রাম পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদ, হিন্দুদের আক্রমণে এক মুসলিমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে’ মর্মে উসকানিমূলক পোস্ট দেন সৈকত মণ্ডল। সেই পোস্টের সূত্র ধরে হামলাস্থলের ঠিক কাছাকাছি একটি মসজিদ থেকে মাইকিং করেন সহযোগী রবিউল ইসলাম। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পীরগঞ্জে ঘটনায় তারা সংশ্লিষ্টতার তথ্য দিয়েছেন সৈকত মণ্ডল (২৪) ও রবিউল ইসলামকে (৩৬)।
তিনি বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অরাজকতা সৃষ্টি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের লক্ষ্যে হামলা-অগ্নিসংযোগসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার ও মাইকিং করে হামলাকারীদের জড়ো করেন বলে জানান।
গ্রেপ্তার সৈকত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক, বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণকে উত্তেজিত করে তোলেন। তিনি হামলা ও অগ্নিসংযোগে অংশগ্রহণে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করেন। তার নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন হামলায় সরাসরি অংশ নিয়ে বাড়িঘর, দোকানপাট ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। তিনি গ্রেপ্তার রবিউলকে মাইকিং করে লোকজন জড়ো করতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন বলে জানান। ঘটনার পরপর তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, এর আগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন পরিতোষ ও উজ্জ্বল। ফেসবুকে উসকানিমূলক মূল পোস্টটি দিয়েছিলেন পরিতোষ। পরিতোষ আর উজ্জ্বলের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক ছিল। পরিতোষ পোস্ট দিয়ে উজ্জ্বলকে বলেন, ধর্মীয় উসকানিমূলক পোস্ট দিলে তোর কেমন লাগে! এরপর পোস্টটি সে ডিলিট করলেও উজ্জ্বল তা কপি ও সেভ করেন। এরপর সেটিই উজ্জ্বল নিজের ফেসবুক পেজ থেকে প্রচার করেন। এরপর সেই পোস্টটি পিক করেন সৈকত। সৈকতের মাধ্যমে সেটি জেনেই রবিউল মসজিদে মাইকিং করেন ও হামলার নেতৃত্ব দেন এবং নিজেও অংশ নেন।
ফেসবুকে ফলোয়ার প্রায় তিন হাজার। ফলোয়ার আরও বাড়াতে ও ব্যক্তিগত ইমেজকে প্রচার করতেই ‘এ মুহূর্তে গ্রাম পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদ, হিন্দুদের আক্রমণে এক মুসলিমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে’ মর্মে উসকানিমূলক পোস্ট দেন সৈকত মণ্ডল। সেই পোস্টের সূত্র ধরে হামলাস্থলের ঠিক কাছাকাছি একটি মসজিদ থেকে মাইকিং করেন সহযোগী রবিউল ইসলাম।
গ্রেপ্তার রবিউল রংপুরের পীরগঞ্জের হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অন্যতম উসকানিদাতা। তিনি স্থানীয় একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন। হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার আগে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মাইকিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন উসকানিমূলক ও মিথ্যাচার করে গ্রামবাসীকে উত্তেজিত করে তোলেন এবং হামলায় অংশগ্রহণের জন্য জড়ো হতে বলেন। তিনি মাইকিংয়ের দায়িত্ব তার আস্থাভাজনকে দিয়ে নিজে সশরীরে অংশগ্রহণ ও নির্দেশনা দেন।
গ্রেপ্তার সৈকতের নির্দেশনায় ও প্ররোচনায় তিনি মাইকিং করাসহ হামলায় অংশগ্রহণ করেন। ঘটনার পর তিনিও আত্মগোপনে চলে যান। গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
কারমাইকেল কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থী ও সংগঠনের সাধারণ নেতাকর্মীর জানান, দর্শন বিভাগের চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র সৈকত মণ্ডল আগে থেকেই সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন। আগেও তার ফেসবুক থেকে ধর্মীয় উসকানিমূলক পোস্ট দেওয়ায় সহপাঠীরা ক্ষুব্ধ ছিলো।
ছাত্রলীগের কামাইকেল কলেজ শাখার সভাপতি সাইদুজ্জামান সিজার বলেন, সৈকত মণ্ডল আগে থেকেই ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে আসছিল। বিষয়টি পীরগঞ্জের ঘটনার আগে আমাদের নজরে আসে। একারণে মহানগর ছাত্রলীগের পরামর্শক্রমে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়।
তিনি বলেন, আমরা যখনই তার বিরুদ্ধে ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্ট ও কমেন্টস করার অভিযোগ পেয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে তাকে কমিটি থেকে বহিষ্কার করেছি। একই সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতাদের বিষয়টি জানিয়েছি।
পীরগঞ্জে হামলার ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না, জানতে চাইলে সিজার বলেন, এটিও প্রশাসন তদন্ত করে জানাবে। তবে আমরা শুনেছি, সৈকত ঘটনার আগ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এসব নিয়ে লেখালেখি করত। এটি আমাদের ছাত্রলীগের রাজনীতির পরিপন্থী। এ কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
গ্রামের বাড়ি মাঝিপাড়া এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৈকতের বাবা রাশেদুল ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নন। তবে সৈকতের দাদা আবুল হোসেন মণ্ডল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদে রয়েছেন। চাচা রেজাউল করিমও সংশ্লিষ্ট ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। সৈকত কারমাইকেল কলেজের দর্শন বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকলেও আগে থেকেই ছিলেন সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন।
স্থানীয়দের দাবি, ঘটনার পর সৈকত মণ্ডল, রবিউল ইসলামসহ অনেকেই গ্রাম থেকে আত্মগোপনে চলে যান। আজ হঠাৎ করেই তারা টেলিভিশনে সৈকত ও রবিউলের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর জানতে পারেন।
তবে তার পরিবারের দাবি, সৈকত মণ্ডল নির্দোষ এবং ঘটনাক্রমে ষড়যন্ত্রের শিকার। পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করার দাবি করে তার চাচা রেজাউল করিম বলেন, আমার ভাতিজা সৈকত মণ্ডল ঘটনার দিন দক্ষিণ মাঝিপাড়ায় অবস্থান করছিল। সেখানে পুলিশ ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম ছিলেন। সেখানে সৈকত উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছে। সবাইকে বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করে পরিতোষ সরকারের ধর্ম অবমাননার বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে অনুরোধ করে। এ কারণে পুলিশ তখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরিতোষকে গ্রেপ্তারের আশ্বাস দেয়। কিন্তু এরই মধ্যে উত্তর মাঝিপাড়ায় আগুন লাগে। এর সঙ্গে সৈকতের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমার ভাতিজা নির্দোষ ও নিরপরাধ।
সৈকতের মা আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাদেকুল পরে আমাদের কইছে বাড়ি থাকি সরি যাও। আমি আমার স্বামী আর সৈকতকে নিয়ে পলাশবাড়ি যাই। সেখান থেকে তিন বাড়ি চেঞ্জ করি। তারপর বোনের বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে আসি। সেখানে র্যাব আমাদের ধরে ফেলে। তখন সৈকতের ঠিকানা বলি। তারা সৈকতকে ধরে।’
নির্দোষ হলে বাড়ি থেকে পালালেন কেন, জানতে চাইলে সৈকতের মা আঞ্জুয়ারা বলেন, ‘চেয়ারম্যান আমাদের সরতে কইছে। রেকর্ড করার ফোন থাকলে রেকর্ড করলেম হয়।’
সৈকত মণ্ডলের দাদা আবুল হোসেন মণ্ডল বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে আওয়মী লীগ করি। যখন এলাকায় কেউ আওয়ামী লীগ করার সাহস পায় নাই, তখন আমরাই আওয়ামী লীগ করেছি। আমরা কেমন করি জামায়াত শিবির হই!’ এ ঘটনায় যারা জড়িত তদন্ত করে তাদের গ্রেপ্তার এবং সৈকতের মুক্তি দাবি করেন তিনি।
সম্প্রতি দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে কোরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা শুরু হয়। এরপর গত ১৭ অক্টোবর রাতে ফেসবুকে এক তরুণের ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠলে পীরগঞ্জে রামনাথপুর ইউনিয়নে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ২৩টি বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করার অভিযোগ ওঠে।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার সকালে দুটি মামলা করেন পীরগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইসমাইল হোসেন। ৪১ জনের নামসহ অজ্ঞাতপরিচয় অনেককে আসামি করে হিন্দুদের বাড়িঘরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটের ঘটনায় একটি মামলা করেন। আরেকটি মামলা করেছেন একজনকে আসামি করে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে।
এরপর বুধবার রাতে পীরগঞ্জ থানার আরেক এসআই সুপথ হালদার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুজনকে আসামি করে তৃতীয় মামলাটি করেন।
পীরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহবুবুর রহমান জানান, এখন পর্যন্ত তিন মামলায় ৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মদদেই হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের ওপর এসবের দায় চাপিয়ে তারা আবারও ক্ষমতায় আসতে চায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের কারণে মানুষের মননে সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই সরকারের শাসনামলেই পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ, কওমি জননী উপাধি দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের তৈরি করা জমিতেই এখন সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের চাষ হচ্ছে।
তারা বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের উসকানি দিতে দেখা গেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই বেড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির পাহারাদার। এদের দিয়ে প্রগতিশীলতা রক্ষা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া যাবে না। সারা দেশে অব্যাহত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ করা, এর সঙ্গে জড়িত ও মদদদাতাদের গ্রেপ্তার-বিচার করা এবং হামলা-লুটপাটের দায় সরকার ও পুলিশ-প্রশাসনকে নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৫
আপনার মতামত জানানঃ