সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের লাগাতার হামলার জেরে ভারতে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিতর্ক আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অথচ এই আইনটিকে মুসলিম-বিরোধী ও অসাংবিধানিক বলে বর্ণনা করে গোটা ভারত জুড়ে যে তীব্র বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়, তা ছিল কার্যত নজিরবিহীন।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ এর নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) পাসের পর থেকেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ। এমনকি দাঙ্গাও বাঁধে দিল্লিতে৷ ২০২০ সালেও সেই সিএএ বিরোধী ঝড় অব্যাহত থাকে।
তবে ওই সময় থেকে বিজেপির বিভিন্ন স্তরের নেতারা অনেক আগে থেকেই এই আইন বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছেন, এখন বিরোধী দলগুলোর অনেক প্রথম সারির নেতাও বলছেন সংশোধিত এই আইনটির পরিধিকে বিস্তৃত করে বাংলাদেশে এখন নির্যাতিত হিন্দুদের সুরক্ষা ও পুনর্বাসনের জন্যও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভারতের পার্লামেন্টে পাস হয়েছিল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ। এই আইনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে আসা হিন্দু-শিখ-খ্রীষ্টান-বৌদ্ধদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়।
তবে গত বছরের মার্চের দেড় বছরেরও বেশি সময় পর আবার ভারতে সিএএ নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক শুরু হলো।
কংগ্রেসে বাড়ছে এই আইনের সমর্থন
দু’মাস আগে কংগ্রেসের এক নেতা ও মুখপাত্র জয়বীর শেরগিল দলীয় লাইনের বিরুদ্ধে গিয়ে সিএএ-র আওতায় আফগানিস্তান থেকে শিখ ও হিন্দুদের ভারতে নিয়ে আসার দাবি তুলেছিলেন।
এবার কংগ্রেসের আর এক সিনিয়র নেতা মিলিন্দ দেওরা কথা বললেন একই সুরে। তিনি বলেন, “সাধারণত দেখা যায় একটা বিল আইনে পরিণত হওয়ার ছমাসের মধ্যেই সেটির বাস্তবায়নের নিয়মকানুনগুলো চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সিএএ পাস হওয়ার দুবছর পরেও সেগুলো কিছুই করা হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, “ওদিকে আমরা দেখছি বাংলাদেশ, আফগানিস্তান সহ উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়েই চলেছেন। তাহলে কি সিএএ শুধুই একটা রাজনৈতিক গিমিক ছিল?”
তিনদিন আগেই মিলিন্দ দেওরা বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে বর্ণনা করে টুইটারে লিখেছিলেন, যারা এখন ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশ থেকে চলে আসতে চাইবেন, তাদেরকেও সিএএ-র আওতায় আনতে আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন।
এদিকে শিবসেনা দলের মুখপাত্র ও এমপি প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদীও টুইট করেছেন, “বাংলাদেশে দুর্গাপুজোর মন্ডপ, ইস্কনের মন্দির ও হিন্দুদের ঘরবাড়ি আক্রান্ত হলেও ভারত সরকার তার নিন্দা করে একটি কথাও বলছে না।”
তিনি সেই সঙ্গেই প্রশ্ন তুলে বলেছেন, “যে সিএএ নিয়ে এত হইচই করা হচ্ছিল, কোথায় গেল সে আইন?”
আর গোটা দেশে যে দলটি সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সবচেয়ে সরব ছিল, সেই তৃণমূল কংগ্রেস কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনার পর এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও মন্তব্যই করেনি। তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি কেন বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন ও সিএএ নিয়ে এখন নীরব, বিজেপি সে প্রশ্নও তুলেছে।
এদিকে গত দুবছরে সিএএ বাস্তবায়নে কেন এক পা-ও এগোনো যায়নি, বিজেপিকেও সে প্রশ্নে অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে। দিল্লিতে দলের মুখপাত্র সঞ্জু ভার্মা এই প্রসঙ্গে বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন সিএএ বাস্তবায়নের নিয়মকানুন খুব শীঘ্রই নোটিফাই করা হবে। দেরির জন্য তিনি কোভিড মহামারিকে দায়ী করেন।
তবে বাস্তবতা হল, বাংলাদেশে গত দশ-বারো দিনে যে সব হিন্দু পরিবার আক্রান্ত হয়েছেন তারা যদি কেউ ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে চলে আসতে চান, তাহলে এ দেশের নাগরিকত্ব আইন তাদের কোনও কাজেই আসবে না। বিরোধী নেতারা অনেকেই এখন আইনটির সেই দুর্বলতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।
পাশাপাশি তারা এটাও বলছেন যে সিএএ বাংলাদেশের হিন্দুদের জীবনযাপনকে সুরক্ষিত করার বদলে আরও কঠিন করে তুলেছে, কারণ এতে তাদের ওপর ভারতে চলে যাওয়ার চাপ বেড়েছে।
কী আছে এই আইনে?
নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ এবং ২০০৯ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (সিএএ) অধীনে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে ভারত। সেখানে মুসলমান ছাড়া সব ধর্মের লোকদের নাগরিকত্ব দেয়ার ঘোষণা দেয় ভারত।
বিজ্ঞপ্তিতে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং গুজরাট, রাজস্থান, ছত্তিসগড়, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের মতো রাজ্যে বসবাসকারী অ-মুসলিমদের (হিন্দু, শিখ, জৈন এবং বৌদ্ধ) ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে এমনটাই জানায় ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মূলত ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী আনা হয়েছে এই বিলের মাধ্যমে। এতে বলা হয়েছে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ সহ আরও কিছু অমুসলিম ধর্মাবলম্বীরা, যারা নিজের দেশে ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে পালিয়ে গেছে, তারা যদি ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সালের আগে ভারতে প্রবেশ করে থাকে, তবে তারা এই আইনের আওতায় ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার উপযুক্ত।
এসব সম্প্রদায়ের মানুষ জন ভারতে ছয় বছর বসবাসের পর সেখানকার নাগরিকত্ব পাবেন যা আগে ছিল এগারো বছর। তাদের কোন কাগজপত্র না থাকলেও চলবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ের আগে এখনকার ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল এটি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ