তালিবান দখলের পর থেকে আফগানিস্তানকে যে অবক্ষয়গুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো গণমাধ্যম। দেশটিতে চলমান অস্থিরতার মধ্যে গত তিন মাসে বহু গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে। হত্যা নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। ক’দিন আগেও নারীদের বিক্ষোভের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে তালিবানের হাতে বেদম মারধরের শিকার হয়েছেন দেশটির একাধিক সাংবাদিক। এর রেশ শেষ হতে না হতেই নারী অধিকার রক্ষার দাবিতে চলা বিক্ষোভে সাংবাদিকদের ফের মারধর করেছে তালিবান। হামলার শিকার সাংবাদিকদের একজন বিদেশিও ছিলেন।এ ঘটনায় দেশটিতে সাংবাদিকরা আতঙ্কে আছেন।
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের উপকণ্ঠে বৃহস্পতিবার সকালে ওই হামলা হয় বলে বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অধিকারের দাবিতে কাবুলে প্রায় ২০ জন নারী আফগানিস্তানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভবনের কাছ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকে মিছিল করে যান।
ওই সময় নারীরা প্ল্যাকার্ড হাতে ‘শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি বন্ধ কর’ স্লোগান দেন। তাদের প্ল্যাকার্ডে ‘আমাদের পড়াশোনা ও কাজ করার অধিকার নেই’ ও ‘বেকারত্ব, দারিদ্র্য, ক্ষুধার অবসান চাই’ লেখা ছিল। ওই নারীদের দেড় ঘণ্টা বিক্ষোভের অনুমতি দেয় তালিবান কর্তৃপক্ষ।
বিক্ষোভ চলাকালে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা তাদের দায়িত্ব পালন করছিলেন। একপর্যায়ে তালিবানের এক যোদ্ধা রাইফেলের বাট দিয়ে বিদেশি এক সাংবাদিককে আঘাত করেন, তাকে লাথি মারেন। আরেক যোদ্ধা ওই সাংবাদিককে ঘুসি মারেন। এ ছাড়া কমপক্ষে আরও দুই সাংবাদিক ওই সময় তালিবান যোদ্ধাদের হামলার শিকার হন।
বিক্ষোভ আয়োজনকারীদের একজন জাহরা মোহাম্মাদি জানান, ঝুঁকি সত্ত্বেও আফগান নারীরা নিজেদের অধিকারের জন্য মিছিল করেছে।
তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি হচ্ছে, দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, নারী থেকে শুরু করে কাউকেই সম্মান করছে না তালিবান। তালিবান মেয়েদের পড়াশোনার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। তাদের স্কুল অবশ্যই খুলে দিতে হবে।’
চলতি বছরের মধ্য আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালিবান। এরপর দেড় মাসের বেশি ধরে দেশটির মাধ্যমিক স্কুলের মেয়েশিক্ষার্থীরা স্কুল যেতে পারছে না। পাশাপাশি আফগান নারীদের কর্মস্থলে কাজ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কট্টর ইসলামপন্থি গোষ্ঠীটি।
মোহাম্মাদি বলেন, ‘আফগান সব মেয়ে ও নারীর প্রতি আমার বার্তা হচ্ছে, তালিবানকে ভয় পেও না। এমনকি তোমাদের পরিবারের সদস্যরা ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি না দিলেও ভয় পাবে না। ঘরের বাইরে বের হও। আত্মত্যাগ কর। নিজের অধিকারের জন্য লড়াই কর। পরের প্রজন্ম যাতে শান্তিতে থাকতে পারে, এ জন্য আমাদের আত্মত্যাগ করতে হবে।’
বিক্ষোভের সময় নারীদের মিছিলের পাশাপাশি শিশুদেরও হাঁটতে দেখা যায়। তবে তারা মিছিলের অংশ ছিল কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এর আগে ২৬ আগস্ট কাবুলে আফগান সংবাদমাধ্যম টোলোনিউজের সাংবাদিক জিয়ার খান ইয়াদ ও তার ক্যামেরাম্যান তালিবানের আক্রমণের শিকার হন।
পরে ১০ সেপ্টেম্বর অন্য আরেক নারী বিক্ষোভের প্রতিবেদন তৈরির সময় কমপক্ষে পাঁচ সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে তালিবান। তাদের মধ্যে দুজনকে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে নির্মমভাবে পেটানো হয়।
বিক্ষোভ চলাকালে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা তাদের দায়িত্ব পালন করছিলেন। একপর্যায়ে তালিবানের এক যোদ্ধা রাইফেলের বাট দিয়ে বিদেশি এক সাংবাদিককে আঘাত করেন, তাকে লাথি মারেন। আরেক যোদ্ধা ওই সাংবাদিককে ঘুসি মারেন। এ ছাড়া কমপক্ষে আরও দুই সাংবাদিক ওই সময় তালিবান যোদ্ধাদের হামলার শিকার হন।
১৫ অগাস্ট আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর সাংবাদিক বৈঠক করে তালিবান মুখপাত্র বলেছিলেন, মানুষের অধিকারের বিষয়গুলির দিকে নজর দেবে তালিবান সরকার। আধুনিক তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু বাস্তবের চিত্র তার সঙ্গে মিলছে না বলেই মনে করছেন আফগানিস্তানের বাসিন্দারা। বিদেশি সংবাদসংস্থার সঙ্গে যে সাংবাদিকরা কাজ করতেন তাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। যারা এখনো আফগানিস্তানে, ভয় এবং আশঙ্কায় দিন কাটছে তাদের।
আফগানিস্তানের গণমাধ্যম বিষয়ে তালিবান নিশ্চয়তা দিলেও অনেক সাংবাদিক শঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না। অনেকেই বলছেন, তাদের জীবন এখন হুমকিতে। এক দিকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে দোলাচল, মহিলা সাংবাদিকদের উপরে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা এবং নামী সাংবাদিকদের দেশ ছাড়ার হিড়িক, অন্য দিকে আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত দেশের সমস্ত টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও স্টেশন।
এর আগে তালিবান বাহিনীর শাসনের সময় দেশটিতে সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধই ছিল বলা চলে। এরপর মার্কিন অভিযানে তালিবানের পতন হওয়ার পর গণমাধ্যম খাতে অগ্রগতি শুরু হয়। এখন আবার ফিরে এসেছে তালিবান শাসন। তাই ভীতিমুক্ত হতে পারছেন না দেশটির সাংবাদিকেরা।
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালিবান শাসনে গণমাধ্যম বলতে কিছু ছিল না। বাহিনীটি টেলিভিশন, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য বিনোদনের মাধ্যমকে ইসলামি মতাদর্শের বিরোধী বলে গণ্য করত। এমনকি সে সময় কিছু কিছু বৈদ্যুতিক পণ্যও অনৈসলামিক হিসেবে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
কেউ টেলিভিশন দেখলে তাকে শাস্তি দেওয়া হতো এবং টিভিটি ভেঙে গুঁড়ো করে দেওয়া হতো। ভিডিও প্লেয়ারের মালিককে গণপিটুনি দেওয়া হতো।
ক্যাসেট ধ্বংস করে এর ফিতা কাবুলের কিছু কিছু এলাকার গাছে ঝুলতে দেখা গেছে। তখন শুধু একটিই রেডিও স্টেশন ছিল। নাম ভয়েস অব শরিয়া। এটি শুধু প্রপাগান্ডা ও ইসলামিক অনুষ্ঠান প্রচার করত।
২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে তালিবান উৎখাত হলে দেশটির গণমাধ্যম খাতে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। সে সময় অনেক টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও নেটওয়ার্ক আসে। শুধু যে সংবাদের চ্যানেল তা নয়, চলচ্চিত্র, নাটক, প্রতিভা খোঁজে বের করার অনুষ্ঠান ও মিউজিক ভিডিও তৈরি হয় প্রচুর।
ন্যাশনাল প্রেস ফেডারেশনের কথা উল্লেখ করে চলতি মাসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) জানায়, আফগানিস্তানে এখন ৫০টি বেশি টেলিভিশন চ্যানেল, ১৬৫টি রেডিও স্টেশন ও কয়েক ডজন প্রকাশনা সংস্থা রয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
আর সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল গণমাধ্যমে মেয়েদের কাজ করার সুযোগ দান। যেখানে তালিবানের শাসনকালে নারীদের পরিবারের বাইরে, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না, সেখানে তালিবান পরবর্তী সময়ে শত শত নারী সাংবাদিকতা, প্রডিউসার, আয়োজক ও পারফর্মার হিসেবে পর্দার সামনে ও পেছনে কাজ করে গেছেন। এমনকি ডজন ডজন সাংবাদিক বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন।
কিন্তু ১৫ আগস্ট তালিবান বাহিনী কাবুলের দখল নেওয়ার পর থেকে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে সংবাদমাধ্যমগুলোতে নারী সাংবাদিকদের উপস্থিতি। বর্তমানে পুরো আফগানিস্তানে মাত্র ৩৯ জন নারী সাংবাদিক কর্মক্ষেত্রে কাজ করছেন বলে জানিয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স। তালিবান কাবুল দখলের আগে ও পরে নারী সাংবাদিকদের ঘরে থাকতে বাধ্য করা, হয়রানি এমনকি মারধোর পর্যন্ত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এক নারী সাংবাদিক ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, বহু সংবাদসংস্থার অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। নারীরাও কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। তিনি যে রেডিও-তে কাজ করেন, সেখানে টেকনিশিয়ানরা পুরুষ। ফলে তিনি অফিসে যেতে পারছেন না।
জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা ও দাতা দেশগুলোর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছাড়া অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশটিতে সংবাদমাধ্যমের সত্য প্রকাশের পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৪
আপনার মতামত জানানঃ