আরবের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ইয়েমেন। এর ওপর মধ্যপ্রাচ্যের মোড়ল সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট গত ছয় বছর ধরে দেশটির ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াইয়ে ইয়েমেনে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার শিশু নিহত অথবা পঙ্গু হয়েছে।এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশটিতে প্রতিদিন চারজন শিশু নিহত হয়েছে। মঙ্গলবার জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বলা হয়ে থাকে, ইয়েমেনের যুদ্ধের আড়ালে আদতে লড়াই চলছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে। ওদিকে আবার সৌদি আরব ও ইরানের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো পরাশক্তিরা। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনীতির কলকাঠি নাড়ছে ইসরায়েল। ইয়েমেনের হাউছি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আবদুল মালিক আল-হাউছির দাবি, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের দেশগুলো গোপনে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা করছে। তারা মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাতে লিপ্ত। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে সৌদি আরবের শাসকরা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোট করেছে।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা- ইউনিসেফ জানিয়েছে, ইয়েমেনে ২০১৫ সাল থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে এ পর্যন্ত ১০ হাজার শিশু হতাহত হয়েছে। একে ‘লজ্জাজনক মাইলফলক’ অ্যাখা দিয়েছে সংস্থাটি।
মঙ্গলবার জেনেভায় এক ব্রিফিং-এ ইউনিসেফের মুখপাত্র জেসম এলডার বলেন, ‘ইয়েমেন সংঘাতে হতাহতের বিষয়ে নতুন এক লজ্জাজনক মাইফলকে পৌঁছেছে। দীর্ঘদিনের যুদ্ধের কবলে পড়ে ১০ হাজার শিশু নিহত অথবা চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশটিতে প্রতিদিন চারজন শিশু নিহত হয়েছে। অনেক শিশুর মৃত্যু বা আহতের খবর অপ্রকাশিত বলেও জানান তিনি’।
তিনি বলেন, হতাহতের এই সংখ্যা দৈনিক গড়ে চারজন শিশুর সমতুল্য। এছাড়া আরও অনেক শিশুর প্রাণহানি এবং আহতের খবর হিসেবের বাইরে রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এল্ডার বলেছেন, ইয়েমেনে প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে চারজন অর্থাৎ মোট এক কোটি ১০ লাখ শিশুর জরুরি মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। পাশাপাশি আরও চার লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ২০ লাখের বেশি শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে।
এভাবে সংঘাত চলতে থাকলে হতাহতের সংখ্যা বাড়ার শঙ্কা জানিয়ে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানান জেমস এলডার। ইয়েমেনের শিশুদের জীবন রক্ষার কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ২০২২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ২৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তার প্রয়োজনের কথা তুলে ধরেন তিনি। তা না হলে দেশটির শিশুদের সাহায্য বন্ধ করতে বাধ্য হবে ইউনিসেফ।
জাতিসংঘের নেতৃত্বে দেশজুড়ে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের প্রচেষ্টা স্থবির হয়ে পড়েছে ইয়েমেনে। কারণ ছয় বছরের বেশি সময়ের এই যুদ্ধে বিরতির বিরোধিতা করেছে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট এবং ইয়েমেনের হুথিরা।
সম্প্রতি দেশটির উত্তরাঞ্চলের মারিব প্রদেশে সরকারি বাহিনী এবং হুথি বিদ্রোহীদের লড়াই চরম আকার ধারণ করেছে। এই প্রদেশের বেশিরভাগ এলাকা হুথিদের দখলে চলে যাওয়ায় সেখানে মানবিক ত্রাণ তৎপরতা এবং জনসাধারণের চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
গ্যাস সমৃদ্ধ মারিবের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে সৌদি জোটের মরিয়া হামলায় গত এক সপ্তাহে প্রায় এক হাজার হুথি বিদ্রোহীর প্রাণহানি ঘটেছে এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ।
সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান হামলায় হুদাদিয়াহ বন্দর ধ্বংসের পর ইয়েমেনের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অনাহারে মারা যাচ্ছে দেশটির শিশুরা। জাতিসংঘ বলছে, বন্দরটি যদি ব্যবহারের উপযোগী না থাকে, তবে শিশুসহ লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটবে।
ইয়েমেনের সাধারণ মানুষের খাবারের চাহিদা মেটাতে সেই বন্দর দিয়ে ৯৫ শতাংশ খাবার আমদানি করা হতো। সৌদি আরব ও তাদের মিত্রদের বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বন্দরটি দিয়ে আমদানি অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
২০১৫ সালের মার্চে থেকে শুরু হওয়া এই গৃহযুদ্ধে এখন পর্যন্ত আট হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে। শিয়া হুথি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানা দখল করে প্রেসিডেন্ট আবেদ রাব্বো মানসুর হাদিকে ক্ষমতাচ্যুত করে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন আরব দেশগুলোর জোট সুন্নি শাসক হাদির পক্ষ নিয়ে হুথিদের বিরুদ্ধে লড়ছে। ইরান হুথিদের পক্ষে সমর্থন দিচ্ছে। গৃহযুদ্ধে ইয়েমেনের স্বাস্থ্য, পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর হিসাবে, কলেরায় এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩০০ জন প্রাণ হারিয়েছে। যার এক-চতুর্থাংশই শিশু। দেশটিতে কলেরায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। পানিবাহিত এ রোগ সহজে নিরাময়যোগ্য হলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে সবার জন্য চিকিৎসা নিশ্চিত করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
ইয়েমেনে প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে চারজন অর্থাৎ মোট এক কোটি ১০ লাখ শিশুর জরুরি মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। পাশাপাশি আরও চার লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ২০ লাখের বেশি শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে।
চলতি বছর এপ্রিলে ইয়েমেনে কলেরাকে মহামারি ঘোষণা করা হয়। কলেরার পাশাপাশি দুর্ভিক্ষের মতো মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে ইয়েমেন।
এদিকে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা হাসপাতালে গিয়েও বাঁচতে পারছে না। কারণ হাসপাতালে বিদ্যুৎ নেই। অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি সব ধরনের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ইয়েমেনের একটি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। আরও বলেন, ‘ক্রমাগত অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু হয়েছে। অপুষ্টিতে ভোগা এসব শিশুরা কেবল দরিদ্র পরিবার থেকেই আসছে না; মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদেরও আমরা চরম অপুষ্টিতে ভুগতে দেখছি। ’
২০১৫ সালের শুরুর দিকে হুথি বিদ্রোহীদের হামলার মুখে সৌদি-সমর্থিত ইয়েমেনের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আব্দ রাব্বু মনসুর আল হাদি ক্ষমতা ছেড়ে সৌদি আরবে পালিয়ে যান। ক্ষমতাচ্যুত এই প্রেসিডেন্টকে ফেরাতে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ইয়েমেনে হুথিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে।
অভিযানের শুরুর পর ইয়েমেনের রাজনৈতিক সংকটের অবসান হওয়ার পরিবর্তে তা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বর্তমানে ইয়েমেনে কার্যত দুই শাসকগোষ্ঠী সক্রিয় আছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক সহযোগিতার ওপর ভর করে দেশটির দক্ষিণাঞ্চল এখনও মনসুর হাদির নেতৃত্বাধীন সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, অন্যদিকে উত্তরাঞ্চল সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে হুথি বিদ্রোহীরা।
ইয়েমেনের এই সংঘাতকে মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্যের লড়াইয়ে সৌদি-ইরানের ‘ছায়াযুদ্ধ’ হিসেবে দেখা হয়। টানা গৃহযুদ্ধ ও সংঘাত চলার ফলে প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এবং এক সময়ের স্বচ্ছল এই দেশ। জাতিসংঘ বলছে, ইয়েমেনের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ খাদ্য ও ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের গুরুতর সংকটে ভুগছেন।
ইয়েমেনের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ইন্ধন জুগিয়েছিল আরব বসন্ত। ক্ষমতার পালাবদলের আগে ইয়েমেনের দীর্ঘকালের প্রেসিডেন্ট ছিলেন একনায়ক আলী আবদুল্লাহ সালেহ। প্রচণ্ড বিক্ষোভের মুখে ২০১১ সালে আবদ রাব্বু মনসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শুরু থেকেই নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছিলেন হাদি। একদিকে জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল, অন্যদিকে ইয়েমেনের দক্ষিণে বিস্তার লাভ করছিল বিচ্ছিন্নতাবাদ। আর হুথি বিদ্রোহীরা তো ছিলই।
ইয়েমেনে ওই সময় আরও কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যা ছিল। আগের প্রেসিডেন্টের প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের আনুগত্য ছিল বিব্রতকর। দুর্নীতি, খাদ্যাভাব ও বেকারত্বের উচ্চ হারের মতো বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে ইয়েমেন। এর মধ্যে শিয়া ধর্মাবলম্বী হুথিরা নতুন করে বিদ্রোহ শুরু করে। নতুন প্রেসিডেন্ট হাদির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উত্তর ইয়েমেনের ‘সাদা’ প্রদেশ এবং এর আশপাশের এলাকা দখল করে নেয় হুথিরা।
এ সময় সুন্নিসহ অনেক সাধারণ ইয়েমেনি নাগরিকও হুথি বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়েছিল। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে সানা দখল করে নেয় হুথিরা। ফলে ইয়েমেনে দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। একটি সরকার পক্ষ, আরেকটি হুথি বিদ্রোহীরা। আলী আবদুল্লাহ সালেহর সমর্থক সেনারাও হাত মিলিয়েছিল হুথিদের সঙ্গে। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে এমন বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান আবদ রাব্বু মনসুর হাদি।
শিয়া হুথি বিদ্রোহীদের ইরান সহযোগিতা করছে— এমন অভিযোগ তুলে এর পরপরই দৃশ্যপটে আসে সৌদি আরব। সৌদিদের পক্ষে যোগ দেয় আরব বিশ্বের সুন্নিপ্রধান আরও ৮টি দেশ। শুরু হয়ে যায় হাদির পক্ষে জোটগত সামরিক অভিযান। এই জোটকে গোয়েন্দা তথ্য ও সামরিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। সেই থেকে ইয়েমেনে হানাহানি চলছেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ