নারী নির্যাতনে চতুর্থ বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে শিশু নির্যাতনের চিত্র উঠে আসছে। এর বাইরেও নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। নিরপরাধ শিশুরা শিকার হচ্ছে খুন, ধর্ষণ কিংবা ভয়াবহ নির্যাতনের। এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দৃষ্টান্ত খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। অনেক সময় ভোক্তভোগী আইনের আশ্রয় নিলেও অপরাধী ফাঁকফোকরে ছাড়া পেয়ে যায়। করোনা মহামারিতে মানুষ যখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে, তখনও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ নেই বরং বেড়েছে।
বড় ফ্রেমে এই সমস্যাটা দেখলে, শিশুর নির্যাতন প্রতিরোধ–সম্পর্কিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০২০ অনুসারে, প্রতিবছর বিশ্বের অর্ধেক শিশু (প্রায় ১০০ কোটি) শারীরিক, যৌন এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার। এর ফলে তারা আহত তো হয়ই, কেউ কেউ প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, কখনো কখনো শিশুদের মৃত্যুও ঘটে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউনেসকো এবং শিশুর নির্যাতন অবসানে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি কর্তৃক গত বছর একটি প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। এতে বাংলাদেশসহ ১৫৫টি দেশে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও সাড়াদানের সাতটি কৌশলসংবলিত ‘ইন্সপায়ার’ (INSPIRE)–এর অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য আছে। এই প্রথম, দেশগুলোর সরকার শিশু নির্যাতন মোকাবিলার জন্য তাদের কাজের বিষয়ে নিজস্ব প্রতিবেদন তৈরি করেছে। কিছু পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা থাকার পরও প্রতিবেদনটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের জন্য শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে দেশগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা দেয় এবং এতে ভবিষ্যতের জন্য বেশ কিছু পরামর্শ আছে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ?
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রায় সব দেশেই (৮৮ শতাংশ) নির্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য আইন রয়েছে, তবে অর্ধেকের কম দেশগুলোতে (৪৭ শতাংশ) আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
এই বিচারে বাংলাদেশে অপরাধীদের খুব কমই বিচারের আওতায় আনা হয়; যার কারণে শিশু নির্যাতন ঘটেই চলেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখিত এক হিসাবে, জরিপের আগের মাসে বাংলাদেশে ১ থেকে ১৪ বছরের শতকরা ৮৯ ভাগ শিশুকে ‘শৃঙ্খলা’ বা কোনো কিছু শেখানোর নামে নির্যাতন করা হয়েছে। শিশু সুরক্ষা নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে আমাদের দেশে শিশুদের শাস্তি বেশির ভাগ মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য।
সম্প্রতি আসকের করা একটি গবেষণা প্রতিবেদন দেখে আঁতকে উঠেছি, আতঙ্কিত হয়েছি। ইউনিসেফ বলছে, দেশের ৫ থেকে ১২ বছরের শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ৭০ শতাংশই যৌন নির্যাতনের শিকার হয় আমাদের দেশে। আর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৭ মাসে হত্যার শিকার হয়েছে ৩৬৫ শিশু। এদের মধ্যে অনেকে গৃহকর্মী। এ ছাড়া ৪৬২ শিশু ধর্ষণ ও অর্ধশতাধিক শিশু বলাৎকারের শিকার হয়েছে। এ সময় শিশুর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ১৯৯টি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, করোনার সময় শিশু ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ও এর ভয়াবহতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। গত বছর ২০২০ সালে একই সময়ে শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ছিল ৯৮৬টি। ২০১৯ সালে বছরজুড়ে ঘটেছিল দুই হাজার ১৮৪টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা। আগের বছর যা ছিল এক হাজার ৫৩২টি।
বাংলাদেশের শিশু আইনে কী আছে?
দেশে শিশু আইন আছে ১৯৭৪ সাল থেকেই। শিশু অধিকার বিষয়ক এই পুরোনো আইনটি সময়ের চাহিদা পূরণে যথার্থ ছিল না। এ জন্য ২০১৩ সালে প্রণীত হয় নতুন একটি আইন।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশুদের বিশেষ অধিকারের কথা বলা আছে। এ অধিকারগুলো শিশুর বেড়ে ওঠা ও নিরাপদ শৈশবের জন্য অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক আইনের এ বিধানগুলো আমাদের ২০১৩ সালের আইনেও স্থান পেয়েছে।
শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি তার হেফাজতে, দায়িত্বে বা পরিচর্যায় থাকা কোনো শিশুকে আঘাত, উৎপীড়ন, অবহেলা, বর্জন, অরক্ষিত অবস্থায় পরিত্যাগ, ব্যক্তিগত পরিচর্যার কাজে ব্যবহার বা অশালীনভাবে প্রদর্শন করে, যাতে সংশ্লিষ্ট শিশুর দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়, শরীরের কোনো অঙ্গ বা ইন্দ্রিয়ের ক্ষতি হয় বা কোনো মানসিক বিকৃতি ঘটে, তিনি এই আইনের অধীন অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং ওই অপরাধের জন্য তিনি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
কোনো শিশুকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার ঘটনা বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩২ ও ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে বর্ণিত অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। শিশু আইন ২০১৩-এর ৭০ ধারা অনুযায়ী শিশুদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক নিষ্ঠুর আচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কেন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলছেন, অপরাধের বিচার না হওয়া একটি বড় কারণ। যেকোন ধরণের অপরাধের যদি বিচার না হয়, দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হয়, তাহলে সমাজে অপরাধ ঠেকানো যাবে না। বাংলাদেশে এক সময় এসিড সন্ত্রাস হতো। কয়েকটি ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবার পর সেটা অনেকটাই কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া অপরাধীদের প্রশ্রয় না দিয়ে সামাজিকভাবে যদি তাদের বয়কট করা যেতো, তাহলেও সমাজে থাকা অপরাধীরা সাবধান হয়ে যেতো। সেটা আমাদের সমাজে এখন হয়না, অনেক সময়ই অপরাধীরা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে আশ্রয়প্রশ্রয় পায়, সেটা বন্ধ করতে হবে শিশুর নিরাপত্তায় পরিবার ও সমাজের সবার যেমন সচেতন হতে হবে, একই সঙ্গে রাষ্ট্রকেও সেই দায়িত্ব নিতে হবে।
বাংলাদেশে ধর্ষণের হাত থেকে শিশুদের রক্ষার জন্যে প্রাতিষ্ঠানিক তেমন কোন ব্যবস্থা নেই বলে মনে করছেন ঢাকায় জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ শাবনাজ জাহিরিন। তিনি বলেন, ধর্ষণ রোধ করে শিশুদের নিরাপদ রাখার জন্য যে ধরণের অবকাঠামো, লোকবল বা সেবা দরকার সেগুলো এখনো অনেক কম।
জাহিরিনের মতে, সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে কমিউনিটি লেভেলে যে ধরণে সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজন আছে সেগুলো এখনো কার্যকর নয়। কিছু সার্ভিস আছে বা লোকজন আছে। কিন্তু শিশুদের বিষয় বা এধরণের ঘটনাকে কেউই সেভাবে আমলে নেন না।
তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সামাজিক কল্যাণ কার্যক্রমের পক্ষ থেকে সোশ্যাল ওয়ার্কারদের থাকার কথা, কমিউনিটি লেভেলে এবং প্রবেশন অফিসার যার একটা বিশেষ দায়িত্ব আছে, অনেক জায়গায়ই তারা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এরা ভালোভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না এবং শিশুদের বিষয়গুলো যেভাবে দেখা উচিত বা কেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম থাকা উচিত সেগুলো এখনো ওইভাবে আমাদের দেশে গড়ে উঠেনি।
শিশু নির্যাতনের কারণ ও প্রতিকার
গবেষকরা বলছেন, করোনা মহামারি সামাজিক অস্থিরতা ও শিশু নির্যাতনের প্রবণতা বাড়িয়েছে। বিচারহীনতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং বিকৃত মানসিকতার কারণে শিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা, ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, অজ্ঞতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রভৃতিকে দায়ী করছেন।
আইন থাকা সত্ত্বেও বন্ধ হয়নি শিশু নির্যাতন। বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনের প্রয়োগ না হলে তা কাগুজে বাঘই রয়ে যায়। আর শিশু নির্যাতনের বিচার করা আরও কঠিন। কারণ শিশুরা ভয়ে নির্যাতনের কথা গোপন রাখে। তাদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়। সেই সঙ্গে অনেক নির্যাতনের কোনো সাক্ষী থাকে না। শিশু নির্যাতনের মতো পৈশাচিক ঘটনার সঙ্গে যেসব অপরাধী জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা আইনগত ও সামাজিক দায়িত্ব। আর সমাজে অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে নজরদারি আরও বাড়াতে হবে।
মনে রাখতে হবে, জাতি গঠনে শিশু অধিকার সুরক্ষা ও শিশু কল্যাণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। করোনার মধ্যেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য শিশুর প্রতি নৃশংসতার ঘটনা ঘটেছে। একের পর এক শিশু নির্যাতনের ঘটনায় দেশের সামগ্রিক শিশু অধিকার আজ প্রশ্নবিদ্ধ। শিশুর শৈশবের সব পর্যায়ের কথা বিবেচনায় নিয়ে সামাজিক আচরণের একটা রূপরেখা তৈরি করে সেটির ব্যাপক প্রচার ও কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পরিবারের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রকে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। নির্যাতনের ঘটনাগুলো তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। তবেই সুফল পেতে শুরু করব আমরা।
এসডব্লিউ/এসএস/২০০০
আপনার মতামত জানানঃ