সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার দায়িত্ব পালনে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। একইসাথে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সোমবার এক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংস্থাটি জানায়, এই ধরনের হামলা বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সংখ্যালঘু বিরোধী মনোভাবের দিকে ইঙ্গিত বহন করছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাউথ এশিয়া ক্যাম্পেইনার সাদ হাম্মাদি বলেন, আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর এই ধরনের আক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, একের পর এক হামলা, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে আক্রমণ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, রাষ্ট্রটি তার সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
অবিলম্বে ঘটনাগুলোর তদন্ত করে যারা এসব সহিংসতা এবং ভাঙচুরের জন্য দায়ী, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানিয়েছেন সাদ হাম্মাদি।
এদিকে বাংলাদেশে সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো।
তিনি বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘৃণা ছড়িয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর সংবিধান পরিপন্থি।
এমন সব হামলা থামাতে বাংলাদেশ সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সোমবার সন্ধ্যায় তিনি তার টুইটে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই আহ্বান জানান।
মিয়া সেপ্পো লিখেছেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর সাম্প্রতিক হামলা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের ফল যা সংবিধানের মূল্যবোধের পরিপন্থী। এটা থামানো উচিত। আমরা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি একটি নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী আরও লিখেছেন, বাংলাদেশ অংশগ্রহণমূলক ও সহনশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা জোরদারের প্রয়াসে যুক্ত হতে আমরা সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
মঙ্গলবার (১২ অক্টোবর) রাতে কুমিল্লার দিঘীরপাড়ের একটি দুর্গাপূজার মণ্ডপে মূর্তির পায়ের ওপরে কোরআন শরিফ রাখার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন বুধবার সকালে দু’জন ৯৯৯ নম্বরে কল করে অভিযোগ জানালে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিষয়টির সত্যতা পায় কোতোয়ালি থানা পুলিশ। ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনওয়ারুল আজিম পূজামণ্ডপে গিয়ে কোরআন শরিফটি উদ্ধার করেন। মূর্তির পায়ের ওপর থেকে কোরআন উদ্ধারের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে ওইদিন সকাল থেকে বিক্ষুব্ধ জনতা নানুয়ার দিঘীরপাড়ে জড়ো হয়ে মিছিল করে এবং দু’টি মণ্ডপে ভাঙচুর চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ারশেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে।
বুধবার দুপুর ১২টার পর জেলা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে দফায় দফায় সংঘর্ষ শুরু হয়। উত্তেজিত জনতা দু’টি মন্দিরে ও একটি পূজার গেটে ভাঙচুর করে। বিকেলে টমছম ব্রিজেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে উত্তেজিত জনতার ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া হয়। বিকেল পৌনে ৫টা পর্যন্ত দফায় দফায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও মিছিলের ঘটনা ঘটে। এতে ছয়জন গুলিবিদ্ধসহ কমপক্ষে ১০০ জন আহত হন। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪০ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এর জের ধরে গত কয়েকদিন হবিগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ ও নোয়াখালীতে কয়েকটি মন্দিরে ভাঙচুর হয়েছে। সব শেষ রোববার (১৭ অক্টোবর) রাত ১০টার দিকে ইসলাম নিয়ে অবমাননাকর একটি ফেসবুক পোস্টের জেরে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ১৩ নম্বর রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া-বটতলা ও বড়করিমপুর গ্রামে হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪৫ জনকে আটক করা হয়েছে।
এ ধরনের ধর্মীয় অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠন নিন্দা জানাচ্ছে। রাজপথে চলছে প্রতিবাদ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের পূজাকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হতে পারে— এটা আগে থেকে আঁচ করতে না পারার বিষয়টি গোয়েন্দা ব্যর্থতা। এর দায় সরকার এড়াতে পারবে না। সাম্প্রদায়িক হামলার কার্যকারণ যা-ই হোক, সহিংসতা মোকাবিলার এই ব্যর্থতার মধ্যেই এই মানবিক বিপর্যয়ের সূত্র খোঁজা চলছে বিভিন্ন মহলে। প্রকাশ্য হামলাকারীদের ঠেকানোয় রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা ঘিরেই প্রশ্নগুলো জ্বলন্ত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৯
আপনার মতামত জানানঃ