খুনের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ভারতের বহুল আলোচিত ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিংসহ চারজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের একটি আদালত। সাজাপ্রাপ্ত অন্যান্যরা হলেন কৃষাণ লাল, জাসবীর সিং, অবতার সিং এবং সাবদিল।
সোমবার ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, কারাদণ্ডাদেশের পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়েছে তাদের সবাইকে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, জরিমানা হিসেবে ৩১ লাখ রুপি পরিশোধ করতে হবে রাম রহিম সিংকে। এছাড়া, সাবদিলকে দেড় লাখ, কৃষাণ লালকে ১ লাখ ২৪ হাজার, জাসবির সিংকে ১ লাখ ২৪ হাজার এবং অবতার সিংকে ৭৫ হাজার রুপি জরিমানা করেছেন আদালত।
এই জরিমানার ৫০ শতাংশ টাকা রণজিৎ সিংয়ের পরিবারকে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। এই মামলায় অপর এক অভিযুক্ত জেলের মধ্যেই মারা যায়। চলতি মাসেই সিবিআই-এর বিশেষ আদালত এই মামলায় পাঁচ অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল।
গুরমিত রাম রহিম সিংয়ের অনুগামী ছিলেন রণজিৎ সিং। কিন্তু রাম রহিমের বিরুদ্ধে দু’জন শিষ্যকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠায় রণজিৎ সিংয়ের বিশ্বাসে ধাক্কা লেগেছিল। তার সঙ্গে মতপার্থক্য হয় ডেরা প্রধানের সঙ্গে। এরপরে ২০০২ সালের ১০ জুলাই কুরুক্ষেত্রের খানপুর কোলিয়া গ্রামের একটি মাঠ থেকে উদ্ধার হয় রণজিৎ সিংয়ের দেহ। তার ছেলে জগসীর সিং এরপরেই অভিযোগ রুজু করেন।
হরিয়ানায় ডেরা সাচ্চা সাওদা নামে একটি আশ্রমের মালিক ছিলেন গুরমিত রাম রহিম সিং। মামলার বিবরনীতে জানা যায়, প্রায় ২০ বছর আগে খুন হওয়া রণজিৎ সিং ওই আশ্রমের ম্যানেজার ছিলেন এবং এই খুনের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিলেন রাম রহিম। বাকি চারজন ছিলেন তার সহযোগী।
আশ্রমের দুই নারীকর্মীকে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৭ সাল থেকে হরিয়ানা রাজ্যের রোহতাক জেলার সুনারিয়া কারাগারে আছেন বিতর্কিত ধর্মগুরু রাম রহিম সিং। আদালতে খুনের মামলার বিচার চলাকালে অন্যান্য অপরাধীরা সশরীরে উপস্থিত থাকলেও সার্বিক নিরাপত্তাজনিত কারণে তাকে আদালতে হাজির করেনি পুলিশ। কারাগারে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনি বিচারকাজে যুক্ত হন।
রায়ঘোষণার দিন রাম রহিমের সেই আশ্রম হরিয়ানার যে এলাকায় অবস্থিত— সেই সিরসা ও এই ধর্মগুরুর অন্যতম প্রধান ঘাঁটি এলাকা পঞ্চকুলায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে হরিয়ানা পুলিশ।
ধর্ষণের অভিযোগে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ভারতের বিতর্কিত ‘ধর্মগুরু’ গুরমিত রাম রহিম সিং ১৯৬৭ সালের ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জন্মেছিলেন রাজস্থানের শ্রীগঙ্গানগর জেলার শ্রীগুরুসর মোদিয়া গ্রামে। ২৩ বছর বয়সে ডেরা সাচ্চা সাওদার প্রধান হওয়ার পর হঠাৎ করেই যেন বদলে যায় তার জীবন।
১৯৪৮ সালের ২৯ এপ্রিল ডেরা সাচ্চা সাওদা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রধান কার্যালয় হরিয়ানার সিরসা জেলায়। ভারতজুড়ে এই ডেরার প্রায় অর্ধশত আশ্রম রয়েছে। ডেরাপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর রাম রহিম হয়ে উঠলেন ব্যতিক্রমী এক ‘ধর্মগুরু’। তার টুইটার অ্যাকাউন্টে ‘আধ্যাত্মিক সাধু’, ‘মানবপ্রেমী’, ‘বহুমুখী গায়ক’, ‘চিত্র পরিচালক’, ‘অভিনেতা’, ‘সংগীত পরিচালক’, ‘লেখক’সহ নানা পরিচিতি রয়েছে। অভিনেতা, পরিচালক ও লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তার কারণে ২০১৬ সালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। বেশ কয়েকটি গানের অ্যালবামও বেরিয়েছে রাম রহিমের। এর মধ্যে হাইওয়ে লাভ চার্জার নামের অ্যালবামটি তিন দিনেই ৩০ লাখ কপি বিক্রি হয়ে যায় বলে খবর রয়েছে। এসব ছাড়াও নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। এক দিনে সর্বোচ্চ পরিমাণ রক্তদানের আয়োজন করে গিনেস বুকে নামও লিখিয়েছে তার ডেরা।
এই গুরমিত রাম রহিম সিং ছিলেন তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। সচ্ছল পরিবারেই জন্ম তার। ডেরা সাচ্চা সাওদা সাবেক প্রধান শাহ সত্যম সিং গুরমিতকে ডেরায় নিয়ে যান। ১৯৯০ সালে সত্যম সিং ২৩ বছর বয়সী রাম রহিমকে তার উত্তরসূরি ঘোষণা করেন। এরপর ক্রমেই বেড়েছে ডেরার ভক্ত আর আশ্রমের সংখ্যা। একটা পর্যায়ে রাম রহিম ভারতের অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তালিকায় চলে আসেন এবং সরকার তাকে জেড-প্লাস নিরাপত্তা দেয়।
তবে খ্যাতি আর ভক্তের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বিতর্কও যেন পিছু ধাওয়া শুরু করে তার। ২০০২ সাল থেকে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ, হত্যাসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ আসতে শুরু করে। তবে ডেরারই এক সাধ্বীর বেনামি চিঠিতেই পতনের সূচনা রাম রহিমের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৭
আপনার মতামত জানানঃ