বিরল প্রজাতির উল্লুক বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী। বাংলাদেশে প্রাণীটি খুব কম সংখ্যায় এখনো টিকে আছে। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ প্রজাতিটি আর বেশিদিন টিকতে পারবে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে নির্বিচারে বন-জঙ্গল উজার এবং বনাঞ্চলে ফলজগাছের দুষ্প্রাপ্যতা। এর ফলে উল্লুক নামের প্রাণীটি এখন মহাবিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। তাদের বসবাসের জায়গা বিনষ্ট হচ্ছে। দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সংকট। আর এই বিপন্নতার জন্য দায়ী মানুষ।
সম্প্রতি বাংলাদেশে এই মহাবিপন্ন উল্লুকের সংখ্যা গণনা করা হয়েছে। দেশে ১৩৫টি গ্রুপে মোট ৪৬৮টি উল্লুকের ধারণা পেয়েছেন গবেষকরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রায় ১২২টি উল্লুকের অবস্থান মৌলভীবাজারের রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টে। লাউয়াছড়া বন উল্লুকের জন্য পরিচিত হলেও সেই বনে ১৩টি গ্রুপে ৪০টি উল্লুক পাওয়া গেছে। পূর্বে ছিল এমন অনেক বনে পাওয়া যায়নি উল্লুকের দেখা।
বাংলাদেশে উল্লুকের সংখ্যা নির্ণয়, বর্তমানে উল্লুকের বসবাসযোগ্য বনের অবস্থা ও সম্ভাব্য বনের তথ্য জানার উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি বৃহৎ গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সিলেট ও চট্রগ্রামের ২২টি বনে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এই সময়ে গবেষকরা ১০৯ দিন বনের মধ্যে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছেন এবং ২০৪.৬৫ কিমি পায়ে হেঁটে তুলে এনেছেন উল্লুকের নানা তথ্য।
বাংলাদেশ বন বিভাগের অনুমতি ও সহায়তায় আমেরিকার ইউএস ফিশ এন্ড ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিসের অর্থায়নে পরিচালিত এই গবেষণাটি চলতি মাসের ৬ তারিখে ডাইভারসিটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষকদলের সূত্রে জানা যায়, বিশ্বে প্রতিবছর ৩.১ শতাংশ হারে কমছে বনভূমি। দক্ষিণ এশিয়াতে বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ ৭৯ মিলিয়ন হেক্টর কিন্তু এই সংখ্যাও কমছে দ্রুত।
সারাবিশ্বে উল্লুক জাতীয় প্রানী আছে ১৯ প্রজাতির। দক্ষিণ এশিয়ার ৩ প্রজাতির উল্লুকের মধ্যে বাংলাদেশে কেবল ওয়েস্টার্ন উল্লুকের দেখা মিলে। ১৯৮০ সালে গিটিংস এবং আকন্দের গবেষণায় বাংলাদেশে ৩ হাজার উল্লুকের অনুমান করা হয়েছিল। তবে ১৯৯০ সালের একটি গবেষণায় ২০০টি এবং ২০০৬ সালের একটি গবেষণায় ২৮২টি উল্লুকের কথা বলা হয়েছে। তবে ১৯৯০ এবং ২০০৬ সালের গবেষণায় গবেষকরা যেসব উল্লুক নিজের চোখে দেখেন শুধু সেগুলো গণনা করা হয়েছে। এই দুইটি গবেষণায় সব বনে যাওয়া সম্ভব হয়নি এবং গবেষণায় অন্তত দেশে উল্লুকের সর্বনিম্ন সংখ্যা জানা গিয়েছিল। এটা জানা যায় যে, ১৯৮০ সালের গবেষণায় বাংলাদেশে যে উল্লুকের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার এখন তা ৪৬৮ তে। অর্থাৎ বাংলাদেশে চার দশকে ৮৪ শতাংশ উল্লুক হ্রাস পেয়েছে।
১৯৮০ সালের গবেষণায় বাংলাদেশে যে উল্লুকের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার এখন তা ৪৬৮ তে। অর্থাৎ বাংলাদেশে চার দশকে ৮৪ শতাংশ উল্লুক হ্রাস পেয়েছে।
বর্তমানের গবেষণাটিতে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তথ্য বিশ্লেষণ গবেষণা করে হয়েছে। দেশের ২২টি বনে ১৩৫টি দলে প্রায় ৪৬৮.৯৬ টি উল্লুক প্রাক্কলন করা গেছে এবং এর থেকে ৪৫.৫টি উল্লুক কম বা বেশী হতে পারে। মূলত যেকোন বন্যপ্রাণী শুমারিতে প্রাণীর সংখ্যার একটা মৌলিক ধারণা প্রকাশিত হয়, মানুষের শুমারির মত বনের কোন নির্দিষ্ট প্রাণীর শতভাগ নির্ভুল সংখ্যা বের করা আদতে সম্ভব নয়।
এই গবেষণায় সিলেট বিভাগের ৬টি বনে উল্লুকের ভাল অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। তার মধ্যে মৌলভীবাজারের রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে প্রায় ১২২টি, পাথারিয়া সংরক্ষিত বনে প্রায় ৯১টি , লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৪০টি, সাগরনালের বনে ২টি, হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ৫টি এবং সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ৯টি উল্লুকের কথা জানা যায়।
এছাড়াও চট্রগ্রাম বিভাগের দীঘিনালা বন, সাজেক ভ্যালি, পাবলা খালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, সাঙ্গু-মাতামুহুরি সংরক্ষিত বন, রামু , থানচিসহ ১৮টি বনে এই গবেষণা চালানো হয়। বেশিরভাগ বনে উল্লুকের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও পূর্বে ছিল এমন কয়েকটি বনে এবার আর তাদের দেখা মিলেনি। তার মধ্যে হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যসহ বেশ কয়েকটি বনে উল্লুকের দেখা মিলেনি।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, উল্লুকের আবাসস্থলে প্রতি ১ বর্গ কিলোমিটারে ০.০৬ থেকে ১.৬৯টি উল্লুকের দল থাকার কথা জানা যায় যা গড়ে দাঁড়ায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ০.৩৯টি উল্লুকের দল।
যেসব বনে গবেষণা করা হয়েছে সে সব বনের ২৯৪.০৬ বর্গ কিমি জায়গা উল্লুকের বসবাসের উপযোগী বলে তথ্য উঠে এসেছে। এর বাইরেও পাবলাখালির উত্তর ও কাসালং বন উল্লুকের বসবাসের উপযোগী হিসেবে জানা যায়।
গবেষক দলের সদস্য সাবিত হাসান জানান, বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার বন ছাড়াও ভারত (উত্তর-পূর্বাংশ), মিয়ানমার (পশ্চিমাংশ) এবং চীনেও (দক্ষিণাংশে) উল্লুক দেখা যায়। নির্বিচারে বন ধ্বংসের ফলে উল্লুকের বাসস্থান, খাদ্য সংকট সৃষ্টি ও শিকার-এদের সংখ্যা হ্রাসের প্রধানতম কারণ। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে উল্লুক শিকারের সাম্প্রতিক কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় এদের শিকারের তথ্য মিলেছে।
উল্লুক Mammalia গোত্রের ছোটখাটো, বৃক্ষবাসী নরবানর প্রজাতি। মাথাসহ এদের শরীর ৪৫-৬৩ সেমি লম্বা, ওজন ৬-৭ কেজি। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ময়মনসিংহের বনাঞ্চলে বাস করে। এরা লেজহীন। হাতগুলো পায়ের চেয়ে অনেক লম্বা। শরীর লোমে ঢাকা। কুঁচকিতে দাঁড়ির মতো লোমগুচ্ছ। বয়স্ক উল্লুক লিঙ্গভেদে দু’রঙের হয়। পুরুষ ঘন কালো, স্ত্রী হলুদ-সোনালি বা ধূসর-বাদামি রঙের। এরা ফলভুক, পাকা ফলই এদের পছন্দ। মধ্য-সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে তিন বছর পর পর বাচ্চা প্রসব করে।
গর্ভধারণকাল ৩-৪ মাস। এরা দিবাচর, রাতে উঁচু ডালে ঘুমায়। ভোরের আগে ওঠে।সন্ধ্যার অনেক আগেই দিনের কাজ শেষ করে। এরা খোলা জায়গায় তেমন আসে না। দু-পাঁচটি উল্লুক এক সঙ্গে থাকে। সাধারণত থে-উ, হু-উ, হো-কো-উ ইত্যাদি স্বরের একটানা ও যৌগিক স্বরে ডাকে। আর এজন্যই এদের নাম উল্লুক।
বিশেষজ্ঞরা জানান, সারাবিশ্বেই উল্লুক একটি বিপন্নপ্রায় প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে এ প্রাণীটি এখন অতি বিপন্নের তালিকায়। খাদ্য ও আশ্রয় সংকটে এই অবস্থা। এক সময় হবিগঞ্জের বনাঞ্চলে এদের উপস্থিতি ছিলে চোখে পড়ার মত। এখন এর পরিমাণ এমনভাবে কমছে যে কালেভদ্রে এদের দেখা মেলে। রেমা-কালেঙ্গা ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে যদি ডুমুরসহ বিভিন্ন ফলের গাছ লাগানো হয় এবং উঁচু গাছ বিনষ্ট না করা হয় তা হলে আমরা মহাবিপন্ন এই প্রাণিটি রক্ষা করতে পারব।
তারা জানান, রেমা-কালেঙ্গা বন যে কোনো সময় উল্লুকশুন্য হয়ে পড়বে। সাতছড়িতে এখনোও কিছু আছে। ব্যাপকভাবে বন ধ্বংসের জন্য এই প্রাণী আজ মহাবিপন্ন। উল্লুক সাধারনত মাটিতে নামে না। বনে খাদ্য ঘাটতি এবং এক গাছ থেকে অন্য গাছের দূরত্ব কমে যাওয়ায় এই প্রাণি যখন নিচে নেমে যায় তখন অনেক আধিবাসী এটিকে শিকার করে ভক্ষণ করে। ফলে প্রাণিটি আজ বিপন্ন।
আরও বলেন, উল্লুকের খাবারের তালিকার বড় জায়গা জুড়েই রয়েছে ফল, এছাড়াও তারা গাছের কচি পাতা, ফুল ও পোকামাকড় খেয়ে থাকে। তারা গাছের মগডালে ঝুলে ঝুলে চলতে পছন্দ করে। যেহেতু তাদের খাবারের বড় অংশ জুড়েই রয়েছে নানান প্রজাতির ফল, সেহেতু তারা মনোকালচার বা সমজাতীয় গাছের বনে থাকতে পারে না। বাংলাদেশের অনেক প্রাকৃতিক বন কেটে এক সময় সেগুলো বাগান করা হয়েছে, সেসব বন থেকে উল্লুক হারিয়ে গিয়েছে। সরকারের উচিত এসব বনকে আবারও তার প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ গ্রহণ করা, যে সকল জায়গায় এখনো উল্লুক টিকে আছে, সেসকল জায়গাকে টিকিয়ে রাখা ও তদারকি করা। এতে করে উল্লুকের সংখ্যা যেমন সারা দেশে বৃদ্ধি পাবে একইসাথে অন্যান্য অনেক বন্যপ্রাণীও সংরক্ষণের আওতায় আসবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৭
আপনার মতামত জানানঃ