যত দিন যাচ্ছে ততই এই পৃথিবী মনুষ্য বাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। এখন হয়তো মনে হবে সবকিছু স্বাভাবিক, সুন্দর, কিন্তু এমনও দিন আসবে যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে শ্বাস নেওয়ার মতো অক্সিজেন থাকবে না। আদতে পৃথিবীকে ঘিরে থাকবে না কোনো বায়ুমণ্ডলই। সূর্যের গা ঝল্সে দেওয়া তাপে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাওয়া আর সাগর-মহাসাগরের সব পানি শুকিয়ে যাওয়ার আগেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে শেষ হয়ে যাবে অক্সিজেন। ছন্নছাড়া হয়ে যাবে আমাদের গ্রহকে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকা ওজোনস্তর নামের রক্ষাকবজ। সূর্যের তাপে জ্বলে-পুড়ে যাবে সাগর, মহাসাগর। ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে আমাদের বায়ুমণ্ডল। অক্সিজেন না পেয়ে মারা যাবে মানুষসহ সব প্রাণী। বাঁচতে পারবে না সালোকসংশ্নেষণের ওপর নির্ভরশীল উদ্ভিদও।
পৃথিবী আবার ফিরে যাবে ২৪০ কোটি বছরেরও আগের পরিবেশে, তখন এ গ্রহের বায়ুমণ্ডল ভরে যাবে বিষাক্ত মিথেন গ্যাসে।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসার বিজ্ঞানীদের গবেষণায় এমন অশনিসংকেত পাওয়া গেছে। বিভিন্ন তাত্ত্বিক মডেল খতিয়ে দেখে করা সাম্প্রতিক একটি গবেষণা এই অশনিসঙ্কেত দিয়েছে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার জিওসায়েন্স’-এ।
গবেষকরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের ঔজ্জ্বল্যের বাড়া-কমার প্রবণতা এবং তার প্রেক্ষিতে বায়ুমণ্ডলে কীভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ কমে-বাড়ে, সেসবের যাবতীয় তথ্যও বিশ্লেষণ করেছেন।
ভিন্গ্রহে কী প্রকৃতির প্রাণের হদিশ মিলতে পারে, সেই প্রাণ বেঁচে থাকে কোন কোন প্রাকৃতিক উপাদানের উপর নির্ভর করে তা জানার লক্ষ্যে নাসার একটি বিশেষ প্রকল্প ‘নেক্সাস ফর এক্সোপ্ল্যানেট সিস্টেম সায়েন্স’-এর অংশ এই গবেষণাটি।
এই প্রকল্পের গবেষকরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের ঔজ্জ্বল্যের বাড়া-কমার প্রবণতা এবং তার প্রভাবে বায়ুমণ্ডলে কীভাবে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ কমে-বাড়ে, সে সবের যাবতীয় তথ্য বিশ্নেষণ করেছেন। এতে ১০০ থেকে ২০০ কোটি বছরের মধ্যেই এই গ্রহ আবার তার জন্মলগ্নের পরিবেশে ফিরে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
দুই মূল গবেষক আমেরিকার জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ভূবিজ্ঞানী অধ্যাপক ক্রিস রেনহার্ড ও জাপানের তোহো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক কাজুমি ওজাকি দাবি করেছেন, ‘‘এই পরিস্থিতি আসবে সূর্যের তাপে পৃথিবী জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাওয়ার আগেই। সেসময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভরে যাবে শুধুই বিষাক্ত মিথেন গ্যাসে। যে গ্যাসে নির্ভর করে বাঁচতে পারে বিশেষ কয়েকটি অণুজীব। তখন মানুষ, অক্সিজেনের উপর নির্ভরশীল কোনও প্রাণী বা সালোকসংশ্লেষ-নির্ভর কোনও উদ্ভিদই আর টিকে থাকতে পারবে না পৃথিবীতে। ২৪০ কোটি বছরেরও আগে এমনই অবস্থা ছিল পৃথিবীর। এই গ্রহ আবার সেই পরিবেশে ফিরে যাবে।’’
গবেষকরা জানিয়েছেন, গবেষণার এই ফলাফল বুঝিয়ে দিচ্ছে, মিথেন বা অন্য কোনও গ্যাস নির্ভর প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে কোনো ভিনগ্রহে। এবার সেই ধরনের প্রাণের খোঁজ-তল্লাশের সময় এসে গেছে।
বায়ুমণ্ডলে ছিদ্র, ধীরে ধীরে ভারসাম্য কমছে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের। ধীরে ধীরে হলেও বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, বায়ুমণ্ডলের এই ছিদ্রই কি পৃথিবীতে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে আনবে? ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার দুটি বিশ্ববিদ্যালয় যৌথ গবেষণা চালিয়ে দেখেছে, বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমান শতাংশের হারে ২১। এই পরিমান আগে ছিল ৩০ শতাংশ। বায়ুমণ্ডলীতে সবথেকে বেশি মাত্রায় রয়েছে নাইট্রোজেন। ৭৮ শতাংশ। বায়ুমণ্ডলীয় গ্যাসবিশেষ ARGON-এর মাত্রা ৯ শতাংশ। কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমান .০৩ শতাংশ।
এই পরিস্থিতি আসবে সূর্যের তাপে পৃথিবী জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাওয়ার আগেই। সেসময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভরে যাবে শুধুই বিষাক্ত মিথেন গ্যাসে। যে গ্যাসে নির্ভর করে বাঁচতে পারে বিশেষ কয়েকটি অণুজীব। তখন মানুষ, অক্সিজেনের উপর নির্ভরশীল কোনও প্রাণী বা সালোকসংশ্লেষ-নির্ভর কোনও উদ্ভিদই আর টিকে থাকতে পারবে না পৃথিবীতে। ২৪০ কোটি বছরেরও আগে এমনই অবস্থা ছিল পৃথিবীর। এই গ্রহ আবার সেই পরিবেশে ফিরে যাবে।
গবেষকরা অনুমান করছেন, অনেক সময় সূর্যের প্রচণ্ড রশ্মির তেজে বায়ুমণ্ডল অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। যার কারণে গ্যাসের আস্তরণে তৈরি হয় ছিদ্র। গ্রহদের মধ্যে পৃথিবী ছাড়া মঙ্গলগ্রহ সহ অন্যান্য গ্রহদের ওপর একটি ম্যাগনেটিক শিল্ডের আবরণ থাকে, যা প্রখর সূর্য কিরণ থেকে বায়ুমণ্ডলীকে রক্ষা করে। ২০১৩ সালে ইউনিয়ন জেনারেল অ্যাসেম্বলির সাধারণ সভায় এই বিষয়ে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আবহাওয়াবিদরা।
দ্রুত পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে আমাদের শ্বাসের বাতাস— অক্সিজেন। এত দ্রুত হারে তা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে মহাকাশে যে, রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন বিজ্ঞানীরা। ওজনে হালকা হয়ে পড়ছে পৃথিবী।
নাসার বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে, নানা রকমের পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, যেমনটা ভাবা হয়েছিল, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল প্রায় সেই ভাবেই উত্তরোত্তর পাতলা হয়ে এলেও, বাতাসের অক্সিজেন প্রত্যাশার চেয়ে অনেক দ্রুত হারে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে মহাকাশে।
দেখা গিয়েছে, সেই হারে কিন্তু পৃথিবী খুইয়ে ফেলছে না গাছপালাদের রান্নাবান্নার (সালোকসংশ্লেষ) জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড। অক্সিজেনের মতো অত দ্রুত হারে পৃথিবীতে কমে যাচ্ছে না বাতাসের নাইট্রোজেন ও মিথেন। যা বেঁচে থাকার জন্য খুব কাজে লাগে অণুজীবদের। বিজ্ঞানীদের অনুমান, বহু কোটি বছর আগে এমন দশাই হয়েছিল আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলের।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যে উত্তরোত্তর পাতলা হয়ে আসছে, তার ধারণাটা আমাদের প্রথম জন্মেছিল গত শতাব্দীর গোড়ায়। ১৯০৪ সালে এমন সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন স্যর জেমস জিনস। তার ‘দ্য ডাইনামিক্যাল থিয়োরি অফ গ্যাসেস’ তাত্ত্বিকভাবে জানিয়েছিল, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এক দিন আমাদের ছেড়ে মহাকাশে হারিয়ে যাবে। সেই দিন পৃথিবীর আর কোনও বায়ুমণ্ডল থাকবে না। ফলে, বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান উপকরণটি আর পাবে না এই নীলাভ গ্রহের জীবজগৎ। তবে সেটা হতে সময় লাগবে আরও অন্তত ১০০ কোটি বছর।
এদিকে পৃথিবীর উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনে মিথেন গ্যাস নির্গমন কমানোর জন্য বিজ্ঞানীরা বারবার তাগিদ দিয়ে আসছেন। প্রাকৃতিক গ্যাসের বাইরে সাধারণত বায়ুশূন্য স্থানে পচনশীল জিনিসপত্র পচে এই গ্যাস উৎপন্ন হয়।
বিজ্ঞানীরা বলেন, কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায় মিথেনের ৮৪ গুণ বেশি ক্ষতি করার ক্ষমতা রয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে দুটো গ্যাসেরই নির্গমন কমাতে হবে। করোনাভাইরাস মহামারির লকডাউন সত্ত্বেও গত বছর বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস পাওয়া গেছে সেটা একটা রেকর্ড।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ওপর এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ কারণ কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর পাশাপাশি মিথেন গ্যাস নিয়েও চিন্তা করতে হবে। যদি এ বিষয়টি উপেক্ষিত রাখি, তাহলে আমাদের বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে। কৃষিপণ্য, তাজা শাকসবজি পচে গিয়ে মিথেন গ্যাস তৈরি হয়। এই গ্যাস যদি আমরা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারি, তাহলে অনেক কাজে লাগবে এবং এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য মিথেন গ্যাসের নিয়ন্ত্রণের ওপর নজর দেওয়া জরুরি।’
তারা বলেন, ‘কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস নির্গমনের সমস্যাটি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বৃদ্ধি পেয়েছে। মিথেন গ্যাসের ছড়িয়ে পড়ার হার যদি কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা না যায়, তাহলে তা আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ