দিন দিন পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হচ্ছে আফগানিস্তানে। ভেঙে পড়া অর্থনীতি, অদক্ষ প্রশাসন আর উপর্যুপরি হামলায় গৃহযুদ্ধের যুগে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে দেশটি। মানুষের মুখে খাবার নেই, কর্মসংস্থান নেই, আছে শুধু মৃত্যু আর ধর্ম।
এবার দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কুন্দুজ প্রদেশের একটি শিয়া মসজিদে শক্তিশালী বিস্ফোরণে ৫৫ জন নিহত এবং ১৪০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। শুক্রবার জুমার নামাজের সময় বিস্ফোরণ ঘটে। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স-এর সূত্রে এই খবর জানিয়েছে ফরাসি সংবাদমাধ্যম এএফপি। আফগানিস্তানে জাতিসংঘ মিশন এক টুইট বার্তায় একে আত্মঘাতী বোমা হামলা উল্লেখ করেছে।
বিস্ফোরণের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন আফগান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কারি সাঈদ খোস্তি। এই মসজিদটিতে অধিকাংশ শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ নামাজ পড়তেন। বিস্ফোরণের সময় সেখানে অন্তত তিনশ’ মুসল্লি ছিল বলে ঘটনাস্থলে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা জানিয়েছেন।
শুক্রবার জুমার নামাজের সময় শিয়া মসজিদে এই হামলার এক ভিডিও ফুটেজে মসজিদের ভেতরে ধ্বংসস্তুপে লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। দুই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রয়টার্স বার্তা সংস্থাকে বলেছেন, মৃতের সংখ্যা ৭০ থেকে ৮০’র মধ্যে হতে পারে।
তালিবানের ঘোর বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) হামলার দায় স্বীকার করেছে। মসজিদে নামাজ চলার সময় মুসল্লিদের ভিড়ে আইএস এর এক আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী বিস্ফোরক বেল্টের বিস্ফোরণ ঘটায় বলে জানানো হয়েছে খবরে।
এমএফএস হাসপাতালের এক কর্মী বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানান, নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, নিখোঁজ আত্মীয়ের কয়েকশ’ মানুষ হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে জড়ো হয়েছেন। তবে ফের বিস্ফোরণের আশঙ্কায় সশস্ত্র তালেবান যোদ্ধারা তাদের আটকে দিচ্ছে।
তালিবান সরকারের বরাতে তুর্কি সংবাদমাধ্যম টিআরটি বলছে, বিস্ফোরণে অর্ধশত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তবে এপিসহ বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে, মৃতের সংখ্যা শতাধিক হতে পারে। হতাহতের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা করছে তালিবান সরকারের প্রশাসন। অনেককেই গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা সংবাদমাধ্যম এএফপিকে বলেন, জুমার নামাজের সময় মসজিদে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনতে পায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ছবিতে দেখা গেছে, মসজিদটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে রাজধানী কাবুলের ঈদগাহ মসজিদের প্রবেশপথের কাছে হামলাসহ কয়েকটি বোমা হামলার ঘটনার পর নতুন করে এই রক্তক্ষয়ী হামলা হল। আগের কয়েকটি বোমা হামলার দায়ও আইএস স্বীকার করেছে।
আফগানিস্তানে একের পর এক এমন বোমা হামলা দেশটির নতুন তালিবান শাসকদের সামনে নিরাপত্তা রক্ষার চ্যালেঞ্জই সামনে নিয়ে আসছে।
কট্টর ইসলামপন্থি গোষ্ঠী তালিবান গত অগাস্টে আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতা দখল করেছে। তারপর থেকে আইএস দমনে কাবুলে এই জঙ্গি গোষ্ঠীটির আস্তানায় অভিযান চালিয়ে আসছে তালিবান।
শুক্রবারের হামলা সম্পর্কে টুইটারে তালিবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, “আজ বিকালে শিয়াদের একটি মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটেছ। এতে অনেকেই মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন।”
তথ্য মন্ত্রণালয় পরিচালিত বখতার বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় ৪৬ জন নিহত এবং ১৪৩ জন আহত হয়েছে।
বিবিসি হামলার ঘটনায় অন্তত ৫০ জন নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছে। স্থানীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে টোলো নিউজ জানায়, হামলার সময় মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে সমবেত হয়েছিল ৩শ’র বেশি মানুষ।
এর আগে অগাস্টে কাবুলের বিমানবন্দরে বড় ধরনের আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছিল আইএস-কে। আইএস-কে গোষ্ঠীর সুন্নি যোদ্ধারা অতীতে বারবারই শিয়া সংখ্যালঘুদের নিশানা করে হামলা চালিয়েছে। আত্মঘাতী হামলা চলেছে মসজিদে, স্পোর্টস ক্লাবে এবং স্কুলেও। সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে আইএস তালিবানের বিরুদ্ধে হামলা জোরদার করেছে।
কাবুলে তালিবান নেতাদের একটি শেষকৃত্যানুষ্ঠানে আইএস হামলা চালিয়েছে কিছুদিন আগেই। পূর্বাঞ্চলীয় নানগহর এবং কুনার প্রদেশেও বেশকিছু ছোটখাট হামলা হয়েছে। এই প্রদেশগুলো আগে আইএস এর ঘাঁটি ছিল।
শুক্রবার কুন্দুজের মসজিদে হামলা দেশের উত্তরে আইএস এর তৎপরতা বাড়ারই আলামত দিচ্ছে। তালিবান বলছে তারা আইএস-এর কয়েক ডজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে এবং গোষ্ঠীটির সাথে সম্পৃক্ত বলে সন্দেহভাজন অন্যদের হত্যা করেছে বলে তারা ধারণা করছে। তবে আইএস তালিবানের জন্য যে বিশাল একটা হুমকি হয়ে উঠছে, সেটা তারা প্রকাশ্যে বড় করে দেখাতে চাইছেন না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বহু আফগান আশা করেছিল তালিবান ক্ষমতা হাতে নেবার পর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এলেও একটা অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু সিকান্দার কিরমানি জানাচ্ছেন তালিবান নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করার যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, আইএস তাতে বড়ধরনের হুমকি হয়ে উঠছে। গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধাহত দেশটি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ