ডিজিটাল যুগে সাইবার হামলা একটি আতঙ্ক। এর মাধ্যমে তথ্য চুরি করে হ্যাকাররা সুযোগ বুঝে ইন্টারনেট ব্যবহারকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইল করে। কখনও কখনও বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়।
জাপানে সদ্য শেষ হওয়া টোকিও অলিম্পিক ও প্যারা অলিম্পিকে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন সাইবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলা প্রতিহত করেছে এই আয়োজনের সাইবার সেল। টোকিও অলিম্পিকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে এসব হামলা চালানো হয়। এক প্রতিবেদনে এমনটি জানিয়েছে তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদুলু।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৩ জুলাই অলিম্পিকের উদ্বোধন থেকে শুরু করে ৫ সেপ্টেম্বর প্যারা অলিম্পিক শেষ হওয়া পর্যন্ত এই সাইবার হামলা হয়। তবে আয়োজক কমিটির মতে, ‘আমরা কোনো ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন না হয়ে সাইবার হামলা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছি’।
জাপান সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ন্যাশনাল সেন্টার অফ ইনসিডেন্ট রেডিনেস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি ফর সাইবার সিকিউরিটি (এনআইএসসি) জানিয়েছে যে, উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানসহ পুরো আয়োজনে অবৈধ অনুপ্রবেশের অসংখ্য প্রচেষ্টা ও সাইবার হামলার পরও কোনো সমস্যা ছাড়াই তা সঠিকভাবে শেষ হয়েছে।
কিয়োডো সংবাদ সংস্থার মতে, একটি প্রধান ইন্টারনেট নিরাপত্তা সংস্থা ট্রেন্ড মাইক্রো জানিয়েছে, ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকে এবং ২০১৮ পিয়ংইয়ং শীতকালীন অলিম্পিকের তুলনায় এই হামলার সংখ্যা কম।
সেখানে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এবারের অলিম্পিকে দর্শক না থাকায় হ্যাকাররা টিকিট এবং দর্শকদের তথ্য নিতে হামলা চালাতে পারেনি।
এর আগে লন্ডন অলিম্পিকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে অন্তত ২ কোটি বার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ওয়েবসাইটে ২৩০ কোটিবার সাইবার হামলা চালিয়েছিল। এছাড়া পিয়ংইয়ং অলিম্পিকে ৬ কোটিবার সাইবার হামলা করা হয়েছিল।
গত বছরের জুলাই ও আগস্টে জাপানের টোকিয়োতে অলিম্পিক গেম আয়োজনের কথা ছিল। করোনা মহামারির কারণে তা অনুষ্ঠিত হয় ২০২১ সালে। তবে যুক্তরাজ্য তখন অভিযোগ করেছিল, স্থগিত ঘোষণার আগেই অলিম্পিকের আয়োজন ভন্ডুল করতে উঠেপড়ে লেগেছিল রুশ হ্যাকাররা।
দেশটির ফরেন অফিস থেকে জানানো হয়েছিল, অলিম্পিক আয়োজনের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে সাইবার হামলা চালিয়েছিল রাশিয়ার জিআরইউ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স। অলিম্পিক গেম স্থগিত ঘোষণার আগেই সে হামলায় চালায় তারা। তবে ঠিক কী ধরনের সাইবার হামলা চালানো হয়েছে, তা নিয়ে বিস্তারিত জানানো হয়নি
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইবার নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ সংস্থা ‘এক্সপার্ট ইনসাইট’ বলছে, করোনাভাইরাসের মহামারির এক বছরে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে র্যানসমওয়্যারের (জিম্মিকারী সফটওয়্যার) হামলা আগের তুলনায় প্রায় ৪০০ শতাংশ বা চার গুণ বেড়েছে। এ সময়ে হামলার শিকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির পরিমাণও দ্বিগুণ বেড়ে ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৬ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
সংস্থাটি ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে র্যানসমওয়্যার হামলা সংক্রান্ত সরকারি ও বেসরকারি তথ্য বিশ্নেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। র্যানসমওয়্যারকে প্রায় এক দশক ধরে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ম্যালওয়্যার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই ম্যালওয়্যার একবার কম্পিউটার কিংবা স্মার্ট ডিভাইসে প্রবেশ করলে তার পুরো অপারেটিং সিস্টেম জিম্মি করে ফেলে। এরপর হামলাকারীরা ডিভাইসটি ফের চালুর জন্য বড় অঙ্কের অর্থ দাবি করে। এ কারণে এ ধরনের হামলাকে ‘সাইবার হাইজ্যাকিং (সাইবার ছিনতাই)’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এটিই বর্তমানে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক ‘সাইবার হামলা’ হিসেবে বিবেচনা করেন বিশেষজ্ঞরা।
এর আগে ওয়াশিংটন ডিসি পুলিশের সার্ভারসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১২০টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান র্যানসমওয়্যার হামলার কবলে পড়ে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ফ্রান্সেও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দফায় দফায় র্যানসমওয়্যার হামলার কবলে পড়ে। ‘এক্সপার্ট ইনসাইট’-এর চলতি বছরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্ভার লক্ষ্য করে হামলা বেড়েছে।
অন্যদিকে, হ্যাকিং সংক্রান্ত তথ্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান ‘হ্যাকারওয়ান’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারির এক বছরে সাইবার হামলার ঝুঁকি সম্পর্কিত হ্যাকারদের তথ্য প্রদানের হার আগের বছরের তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেড়েছে। এর অর্থ, মহামারির সময়ে হ্যাকাররা আগের বছরের তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি সময় ব্যয় করেছে বিশ্বজুড়ে সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঝুঁকি পর্যবেক্ষণের জন্য।
হ্যাকারওয়ান প্রকাশিত ‘দ্য হ্যাকার রিপোর্ট ২০২১’-এ বলা হয়েছে, মহামারিকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানের সাইবার নিরাপত্তা বলয় বা ব্যবস্থা তৈরির পরিমাণ আগের তুলনায় প্রায় ৩১০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যথাযথভাবে হালনাগাদ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়নি বা ‘মিস কনফিগারেশন’ করা হয়েছে। একই সঙ্গে নিয়মিতভাবে ব্যবস্থার হালনাগাদও করা হয়নি। বিশেষ করে এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো থেকে সাইবার নিরাপত্তার দুর্বলতার চিত্র বেশি উঠে এসেছে। এর ফলে বিভিন্ন ম্যালওয়্যার আক্রমণের অনেক নতুন লক্ষ্যবস্তু তৈরি হয়েছে গত এক বছরে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৪
আপনার মতামত জানানঃ