এবার চীনের বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ এনেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই অভিযোগ বড় আকারের সাইবার হামলা ও গুপ্তচরবৃত্তির। অভিযোগ করা হয়, চলতি বছর জানুয়ারিতে এ হামলা হয়েছিল। এ সম্পর্কিত বিবিসি ও রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মাইক্রোসফট এক্সচেঞ্জ সার্ভারে এই হামলা হয়েছিল। এতে বিশ্বজুড়ে কমপক্ষে ৩০ হাজার সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে চীনের সাইবার আচরণ নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। চীনের মিনিস্ট্রি অব স্টেট সিকিউরিটির বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে গুপ্তচরবৃত্তি এবং ভয়াবহ বেপরোয়া আচরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা বলছে, এর আগে চীন যে ধরনের হ্যাকিং করেছে, বর্তমান প্রেক্ষাপট তার চেয়ে অধিক গুরুত্বর
পালস সিকিউর হ্যাক
চীনের ‘পালস কানেক্ট সিকিউর’ নেটিওয়ার্কিং ডিভাইস হ্যাকের বিষয়টি গত এপ্রিলে প্রকাশ্যে এলেও বর্তমানে এর কার্যক্রম স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, হ্যাকাররা টেলিকমিউনিকেশন জায়ান্ট ভেরিজন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম পানি এজেন্সি’কে নিশানা করেছিল।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিতে দেশটির বৃহত্তম পাতাল রেল ব্যবস্থাও হ্যাকারদের কবলে পড়েছে বলে এ মাসের শুরুতে খবর ছড়িয়ে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান জ্বালানি পাইপ লাইনসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো র্যানসামওয়্যার হামলার শিকার হওয়ার খবর গণমাধ্যমের শিরোনামে এলেও পালস সিকিউরের হ্যাকিংয়ের বিষয়টি তেমন কারও নজরে আসেনি। পালস সিকিউর মূলত বিভিন্ন কোম্পানি ও সরকার নিজেদের নেটওয়ার্কের নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করে থাকে।
সন্দেহ করা হচ্ছে, রাষ্ট্র-সমর্থিত হ্যাকারদের মাধ্যমে চীন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোর কম্পিউটারে প্রবেশ করতে ইন্টারনেট সুরক্ষা বাড়াতে পারে এমন ডিভাইস ব্যবহার করছে।
চীনকে দায়ী করছে পশ্চিমারা
পশ্চিমা দেশসমূহের নিরাপত্তা সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের জানুয়ারির দিকে হাফনিয়াম নামে একটি চীনা হ্যাকার দল মাইক্রোসফট এক্সচেঞ্চের সার্ভারে ঢুকে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে।
চুরি হওয়া এসব তথ্যে মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য ও মেধাগত সম্পত্তি (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি) রয়েছে।
চীনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয় (এমএসএস) এই হামলার সঙ্গে যুক্ত ও নির্দেশদাতা বলে মনে করছেন পশ্চিমা নিরাপত্তা সংস্থাসমূহের কর্মকর্তারা।
যেসব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহের তথ্য চুরি হয়েছে সেগুলো বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ও থিঙ্কট্যাঙ্ক সংস্থা। এছাড়া বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং এসবের আওতাধীন সংস্থাসমূহও এ তালিকায় আছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে এ হামলা চালানো হয়েছে। যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে এ হামলাকে বড় ধরনের গুপ্তচরমূলক কার্যক্রম বলে অভিযোগ করেছে। পাশাপাশি উল্লেখ করেছে চীনে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিযুক্ত হ্যাকাররা এ হামলার জন্য দায়ী।
চীনকে বাঁচাতে চাইছেন জো বাইডেন!
গতকাল সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেন বলেছেন, সাইবার জগতে দায়িত্বজ্ঞানহীন, বিশৃঙ্খল এবং অস্থিতিশীল ধরনের আচরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশ পিপলস রিপাবলিক অব চীনকেই দায়ী করছে। চীনের এই আচরণ আমাদের অর্থনীতি এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিকিন রাব বলেছেন, চীনের সরকারকে এই ধরনের ধারাবাহিক সাইবার হামলার অবসান ঘটাতে হবে; তা না হলে তাদেরকে জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অবশ্য সরাসরি চীনকে দায়ী করেননি, তবে অভিযোগ করে বলেন, চীনের ক্ষমতাসীন সরকার হামলাকারী হ্যাকারদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে।
সোমবার এক বার্তায় তিনি বলেন, আমি যদ্দুর বুঝতে পারছি, চীন সরকার সরাসরি এই হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়; তবে যেসব হ্যাকার এই হামলা চালিয়েছে, তাদরকে বিভিন্নভাবে মদদ ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে দেশটির সরকার। এমনও হতে পারে, তাদেরকে এ বিষয়ক প্রশিক্ষণও দিয়েছে চীনের সরকার।
অভিযোগ নিয়ে যা বলছে চীন
চীন অবশ্য এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপন ‘দায়িত্বশীলতার’ পরিচয় নয়।
ওয়াশিংটনে চীনা দূতাবাসের মুখপাত্র লিউ পেনগিউ গতাকাল সোমবার এক বিবৃতে বলেন, এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপন দায়িত্বশীলতার পরিচয় নয়।
সাইবার হামলা বা সাইবার মাধ্যমে চুরি জাতীয় কোনো প্রকার কার্যক্রমের সঙ্গে চীনের ক্ষমতাসীন সরকার, সরকারি কর্মকর্তা ও সরকার সংশ্লিষ্ট কোনো লোকজনের কোনো সম্পর্ক নেই।
যদিও মার্কিন ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স দপ্তরের পরিচালক বলেছেন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে গুপ্তরচরবৃত্তি করার দীর্ঘ ইতিহাস চীনের রয়েছে।
ছয় বছর আগে চীনা হ্যাকাররা যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব পারসোনেল ম্যানেজমেন্ট থেকে কর্মচারীদের লাখ লাখ ব্যক্তিগত তথ্যের নথি চুরি করে।
কতটা ক্ষতির সম্মুখীন পশ্চিমারা!
এটা স্পষ্ট নয় যে, কোন সংবেদনশীল তথ্য হ্যাকারদের হাতে পড়েছে, কিংবা আদৌ এসব তথ্য হ্যাকাররা হাতে পেয়েছে কি না। যারা গুপ্তরচরবৃত্তির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল তাদের কেউ কেউ বলেছেন, তারা কোনো ডেটা চুরির প্রমাণ দেখতে পাননি।
এ ধরনের অনিশ্চয়তা সাইবার গুপ্তচরবৃত্তিতে সাধারণ বিষয়। তবে ডেটা চুরির বিষয়টি ধরা পড়তে পারে; কখনও কখনও ধরা পড়েও না এবং এতে ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।
এদিকে, কোন গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সে বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি পালস কানেক্ট সিকিউরের উটাহ ভিত্তিক মালিক ইভান্তি। তবে যদি সংবেদনশীল তথ্য হ্যাক নাও হয়, তবুও উদ্বেগজনক বিষয়টি হলো, হ্যাকাররা এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় হানা দিতে পেরেছে, যেগুলো বাণিজ্যিক বা জাতীয় নিরাপত্তার কারণে চীনের আগ্রহের জায়গা।
মার্কিন সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ম্যানডিয়ান্ট-এর প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা চার্লস কার্মাকাল বলেছেন, ‘সাইবার হুমকিদাতারা কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় ও সুরক্ষিত সংস্থায় হানা দিতে সক্ষম হয়েছিল।’
প্রসঙ্গত, চার্লস কার্মাকালের ম্যানডিয়ান্টই গত এপ্রিলে প্রথম হ্যাকিংয়ের বিষয়টি প্রকাশ্যে আনে।
বার্তা সংস্থা বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর ফলে বিশ্বজুড়ে অন্তত ৩০ হাজার প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সার্ভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চীনের কোম্পানিসমূহ এবং ব্যবসা লাভবান হয় এমনসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেওয়াই ছিল সেই সাইবার হামলার লক্ষ্য।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নরওয়ে, সৌদি আরব, সাউথ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান এ হামলার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ