করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও দেশে কন্যা শিশুর যৌন নির্যাতন উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এবছর কন্যাশিশুর যৌন নির্যাতনের হার বেড়েছে ৭ শতাংশ। গত ৮ মাসে দেশে ৮১৩ জন কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার, ৯ জন অপহরণ, ১৪০ জন পাচারের শিকার ও ১১২ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। এ বছর বাল্যবিয়েও বেড়েছে ১৩ শতাংশ। গত ১ বছরে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন ১২৫৩ জন।
আজ (বৃহস্পতিবার) কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন ২০২১ প্রকাশ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সামাদ হলে অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজক ছিল জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, দেশের মধ্যে কন্যাশিশু অপহরণ ও আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে রাজশাহী বিভাগে। কন্যা শিশুদের হত্যা, এসিড নিক্ষেপ, উত্ত্যক্ত ও অবহেলা বেশি ঘটে চট্টগ্রাম বিভাগ আর ধর্ষণের শিকার ঢাকা বিভাগের কন্যাশিশুরা বেশি।
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি বলেন, গত আট মাসের ২৪টি জাতীয়, স্থানীয় ও অনলাইন গণমাধ্যম থেকে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ থেকেই বোঝা যায় কন্যা শিশুদের ওপর কী পরিমাণ নির্যাতন করা হচ্ছে। এসবের সমাধানে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।
নাছিমা আক্তার উল্লেখ করেন, ২০১৬-২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণ মামলা হয়েছে। প্রতি বছর এ মামলার পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এছাড়া ২০২০ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে এক হাজার ২৫৩ জন কন্যাশিশু।
প্রতিবেদনে যৌতুক, গৃহকর্মী নির্যাতন, আত্মহত্যা ও হত্যাসহ নানা নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে এ বিষয়ে ৯টি সুপারিশ করেছে ফোরাম। শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ ঘটনাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত সময়ে বিচার শেষ করা, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, কন্যাশিশু নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করা, পৃথক অধিদপ্তর গঠন, বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো।
অনুষ্ঠানে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার সঞ্চালকের বক্তব্যে বলেন, আমাদের সব ক্ষেত্রেই দলীয়করণ হয়ে গেছে। এটার একটা মাশুল আমরা দিচ্ছি। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের দেশে আইনের শাসন নেই। গণমাধ্যমে আসলেই আলোচিত হয়। তার আগে কোনো ঘটনাকে এতোটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
দেশের মধ্যে কন্যাশিশু অপহরণ ও আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে রাজশাহী বিভাগে। কন্যা শিশুদের হত্যা, এসিড নিক্ষেপ, উত্ত্যক্ত ও অবহেলা বেশি ঘটে চট্টগ্রাম বিভাগ আর ধর্ষণের শিকার ঢাকা বিভাগের কন্যাশিশুরা বেশি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকারের সময় এমন পরিস্থিতি হয়েছে তা নয়। আমরা দেখেছি এই পরিস্থিতি বিগত সরকারের সময়ও ছিল। ক্ষমতাসীনরা এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই জড়িত থাকে।
তিনি জানান, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। এখানে অনেকগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
আজ জাতীয় কন্যা শিশু দিবস
জাতীয় কন্যা শিশু দিবস, ৩০শে সেপ্টেম্বর। অন্যান্য বছরের মতো এবারো দিবসটি যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হচ্ছে। লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে প্রতিবারের মতো এবারও দিবসটি পালন করবে বাংলাদেশ। এবারের প্রতিপাদ্য ‘আমরা কন্যা শিশু, প্রযুক্তিতে হবো সমৃদ্ধ, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়বো।’
আজ ৩০ সেপ্টেম্বর কন্যা শিশু দিবস হলেও আগামীকাল ১ অক্টোবর বিশ্ব শিশু দিবস এবং ২ অক্টোবর থেকে শিশু অধিকার সপ্তাহ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শিশু অধিকার দিবসের পাশাপাশি গত ১২ বছর ধরে বাংলাদেশে কন্যা শিশুদের অধিকার আদায়ের জন্য কন্যা শিশু দিবসটিও জাতীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো প্রতিবছর এ দিবসটি বেশ গুরুত্ব দিয়ে পালন করে থাকে। তবে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন দিনে দিবসটি পালন করে থাকে। বাংলাদেশে ৩০ সেপ্টেম্বর দিবসটি পালন করা হয়। মূলত কন্যা শিশুদের শিক্ষার অধিকার, খাদ্য ও পুষ্টির সুরক্ষা, আইনি সহায়তা ও ন্যায় বিচারের অধিকার, চিকিৎসা সুবিধা ও বৈষম্য থেকে সুরক্ষা, নারীর বিরুদ্ধে হিংসা ও বলপূর্বক বাল্যবিবাহ বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে এ দিবসের সূচনা হয়।
কানাডা প্রথম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালনের প্রস্তাব দেয়। পরে ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর তারিখে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় এ প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর প্রথম আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালন করা হয়। প্রথম এ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘বাল্য বিবাহ বন্ধ করা’।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছেলে হোক বা মেয়ে হোক প্রতিটি সন্তানেরই বেড়ে ওঠার অধিকার রয়েছে এবং তাই হওয়া স্বাভাবিক। অথচ আমাদের দেশে সব সময়েই কন্যা শিশুকে অত্যন্ত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখা হয়। এখনো এ দেশের অনেক প্রত্যন্ত গ্রামে ছেলে শিশু জন্মগ্রহণ করলে সৃষ্টিকর্তার ‘নিয়ামত’ এবং কন্যা শিশু জন্মগ্রহণ করলে ‘অভিশাপ’ হিসেবে ধরা হয়। ছেলে শিশু জন্মগ্রহণের পর অনেক পরিবারেই আনন্দের সীমা থাকে না। কিন্তু মেয়ে শিশু জন্ম মানেই যেন ওই পরিবারে টেনশনের বার্তা।
তারা বলেন, কন্যা সন্তানরা শিশুকাল থেকেই সামাজিক, পারিবারিক, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নানা বৈষম্যের শিকার হতে হতে বেড়ে ওঠে। কন্যা শিশুর প্রতি অবহেলা অনেক সময় তাদের এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়। কন্যা শিশুদের অধিকাংশই শিশুকাল থেকেই ইভটিজিং বা যৌন হয়রানি, এসিড সন্ত্রাস, অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদির শিকার হয়। এমনকি যে পরিবার কন্যা শিশুর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হবার কথা সেখানেও তাদের নিরাপত্তা অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ। নানা বৈষম্য, অত্যাচারের শিকার হয়ে অনেকেই নিজ পরিবারেই হয়ে পড়ে অসহায়।
তারা আরও বলেন, আসলে আদিকাল থেকেই পরিবার ও সমাজে কন্যা শিশুরা অবহেলিত। এক্ষেত্রে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার প্রভাব বিস্তার করছে। এগুলো ভাঙতে হবে। সমাজের অসঙ্গতি ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ অবদান রেখেছেন। তাদের পথ অনুসরণ করে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব নেওয়া উচিত। কারণ কন্যা শিশুকে বাদ দিয়ে আমরা কখনো টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবো না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৬
আপনার মতামত জানানঃ