প্রথমবারের মতো তিউনিসিয়ার প্রধানমন্ত্রী হলেন একজন নারী। কয়েক মাস ধরে চলা রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে দেশটির প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদ তাকে নিয়োগ দিলেন। ফলে তিউনিসিয়া তো বটেই, আরববিশ্বের মধ্যে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন নাজলা। কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা ও মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এ তথ্য জানিয়েছে।
গত জুলাইয়ে আগের প্রধানমন্ত্রীকে বহিষ্কার ও পার্লামেন্ট স্থগিত করে নির্বাহী ক্ষমতার সিংহভাগ নিজের করে নেন প্রেসিডেন্ট সাইদ। এরপর থেকে নতুন সরকার গঠনের জন্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে চাপ বাড়ছিল তার ওপর। এ অবস্থায় গত সপ্তাহে সংবিধানের বেশিরভাগ অংশ বাতিল করে ডিক্রির মাধ্যমে দেশ শাসনের বন্দোবস্ত করেন সাইদ। সে বিধানমতেই নাজলাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেছেন এ নেতা।
তিউনিসিয়ান প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। এতে সাইদ ও নাজলাকে বৈঠক করতে দেখা যায়। এসময় নাজলাকে আগামী কয়েক ঘণ্টা অথবা দিনের মধ্যে নতুন সরকার গঠনের ভার দেওয়া হয়।
ভিডিওতে সাইদকে বলতে শোনা যায়, তিউনিসিয়ার ইতিহাসে এই প্রথম কোনো নারী সরকারের নেতৃত্ব দেবেন। এটি তিউনিসিয়া ও তিউনিসিয়ার নারীদের জন্য অত্যন্ত সম্মানের বিষয়।
সাইদ বলেন, নতুন সরকারের প্রধান মিশন হবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটানো।
তিনি আরও বলেন, নতুন সরকারের উচিত স্বাস্থ্য, পরিবহন এবং শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে তিউনিসিয়ানদের দাবি ও মর্যাদার প্রতি সাড়া দেওয়া।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, ৬৩ বছর বয়সী নাজলার বিশ্বব্যাংকে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিউনিসিয়ার উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জ্যেষ্ঠ পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ভূতাত্ত্বিক প্রকৌশলে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী এ নারী দেশটির ন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের একজন প্রভাষক।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, তিউনিসিয়ার ব্যক্তি মালিকানাধীন মোসাইক এফএম অনুসারে, ৬৩ বছর বয়সী রোমধান ২০১১ সাল থেকে দেশটির উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
রোমধানে এমন একটি সময় দেশটির ক্ষমতা নিচ্ছেন যখন দেশটিতে জাতীয় সংকট চলছে। ২০১১ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে তিউনিসিয়ায় গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু করে। বর্তমান দেশটিতে ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকট চলছে।
করোনা মহামারিতে ধনপতিদের সম্পদ পাহাড়সম হয়েছে আর নিঃস্ব হতে চলেছে স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশগুলো। বিশ্ব অর্থনীতির আকস্মিক এই দুর্ভাগ্য থেকে তিউনিসিয়াও মুক্ত থাকেনি। তিউনিসিয়ায় মোট জিডিপির প্রায় ২০ শতাংশের জোগান দেয় পর্যটনশিল্প। কিন্তু করোনা মহামারির দরুন অন্যান্য বছরের তুলনায় পর্যটন আয় নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে।
তিউনিসিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে পর্যটন খাতে আয় ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যার দরুন বেকারত্ব বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। ১১ মিলিয়ন মানুষের দেশের প্রায় ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ কাজ করেন পর্যটনশিল্পে। এই অর্থনৈতিক দুর্দশার সঙ্গে যোগ হয়েছে নিত্যনতুন রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিক্ষোভ, সেনা অভ্যুত্থানের এবং সন্ত্রাসী হামলার গুজব তিউনিসিয়ায় মানুষের জীবনকে অস্থির করে তুলেছে। অথচ ১০ বছর ধরে তিউনিসিয়ায় গল্প এ রকম মলিন ছিল না কখনোই।
তথাকথিত ‘আরব বসন্তের’ সূতিকাগার ছিল তিউনিসিয়ায়। ‘বসন্ত’পরবর্তী সময়ে রক্ষণশীল-সেক্যুলারদের মধ্যকার আলোচনা এবং বোঝাবুঝির দরুন সিরিয়া, লিবিয়া ও মিসর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আখ্যানের অংশীদার ছিল তিউনিসিয়া। কিন্তু ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অচেনা এক আইনের প্রফেসর কাইস সাইদ ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচন জিতে নিলে রক্ষণশীল আন নাহদা আর নানানভাবে বিভক্ত হওয়া সেক্যুলার গোষ্ঠী অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। রাজনীতিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখতে প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলো চলমান সহাবস্থান ত্যাগ করে নিজেদের পাল্লা ভারী করার স্বার্থে আদর্শিক রাজনীতির পেছনে ছুটতে থাকে। ফলাফলস্বরূপ অস্থিরতা শুরু হয়েছিল অর্থনীতিসহ রাষ্ট্রের প্রায় সব বিভাগে। তবে এককভাবে তিউনিসিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোকে এই সমস্যার জন্য দায়ী করার সুযোগ নেই। আঞ্চলিক রাজনীতির মারপ্যাঁচও অনেকাংশে তিউনিসিয়ার বর্তমান এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৬
আপনার মতামত জানানঃ