সেনাবাহিনীর সহায়তায় তিউনেসিয়ার প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদ দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিশাম মেশিশিকে বরখাস্ত করেছেন। এ ছাড়া সরকার ভেঙে দিয়েছেন এবং পার্লামেন্ট স্থগিত করেছেন প্রেসিডেন্ট।এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে।
কয়েক বছর ধরে চলা অচলাবস্থা, ক্রমহ্রাসমান রাষ্ট্রীয় পরিষেবা ও বাড়তে থাকা বেকারত্বের কারণে ইতোমধ্যেই অনেক তিউনিসীয় তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ছিল। এরপর কোভিড-১৯ মহামারী শুরু হওয়ার পর দেশটির অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে ওঠে এবং করোনাভাইরাস সংক্রমণ হার বাড়তে শুরু করে।
বেতন-ভাতা পেতে দেরিসহ ওষুধ ও খাদ্যশস্য সংকটে পড়েছেন তিউনিসিয়ানরা। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন দেশটির জন্য এটা বড় ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্কটের ইঙ্গিত; যেটিকে হয়তো কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
তিউনিসের ইত্তাহরির শহরের বাইরে একটি দোকানে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন লেগে থাকছে। যোগান কমে যাওয়ায় দোকানটি এখন আগের চেয়ে কম সময় খোলা থাকছে।
সেখানে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন আহমেদ বিন সালেম নামে একজন ট্যাক্সিচালক। তিনি বললেন, এটাই প্রথম দোকান না যেখানে এসে আমি কিছু কিনতে পারলাম না। গত মাস ধরেই আমাকে সুজি করতে প্রতিদিন বিভিন্ন দোকানে ঘুরতে হয়। আমি দোকানে দোকানে ঘুরি আর হতাশ হই।
নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যই তিউনিসিয়াকে আমদানি করতে হয় ও দেশে ভর্তুকি দিয়ে সেগুলো বিক্রি করতে হয়। এদিকে দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সংবিধানে পরিবর্তন আনতে চান প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদ। এ নিয়ে দেশটিতে এক ধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনা রয়েছে। আর এখন এর ওপর তিউনিসীয়দের জীবনযাত্রায় কোনো পরিবর্তন এলে তা রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও ঘোলা করবে।
একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সংবিধানে পরিবর্তন আনতে চান প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদ। এ নিয়ে দেশটিতে এক ধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনা রয়েছে।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য প্রশাসনিক ত্রুটি, শ্রমিক ধর্মঘট, ফটকা ব্যবসায়ী ও বিরোধীদের দুষছেন প্রেসিডেন্ট ও দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা।
গত মাসে প্রেসিডেন্ট সাইদ বলেছিলেন, তারা চায় এ দেশের মানুষ খাদ্য ও ওষুধ সঙ্কটে পড়ুক।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আসলে তহবিল সঙ্কটে ভুগছে তিউনিসিয়া। যার জন্য তারা বিদেশি সাপ্লাইয়ারদের ও দেশে সরকারি কর্মীদের বেতন দিতে পারছে না।
ইন্টারন্যাশনাল মনেটারি ফান্ডের (আইএমএফ) একটি রেসকিউ প্যাকেজ নিয়ে বেশ কয়েকবারই আলাপ হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বারবারই সে আলাপ থেমে গেছে। তবে গতমাসে এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেছে।
তিউনিসিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর মারৌনি আব্বাসি বলছেন, ভেনেজুয়েরা ও লেবাননের মতোই অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে রয়েছে তিউনিসিয়া।
লতিফ মানসৌরি নামে ৫৫ বছর বয়সী এক শিক্ষক বলেন, এখানে এমন শিক্ষক আছেন যাদের সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবতে হয় সারাটা দিন কিভাবে চলবে।
জানুয়ারিতে শিক্ষকরা এক সপ্তাহ দেরিতে তাদের বেতন পেয়েছেন। কূটনীতিকরা বলছেন, সরকার যদি আইএমএফের সাথে কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে না পারে তাহলে সামনে বেতন পেতে আরও দেরি হবে।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, ডিসেম্বর থেকে বন্দরে শস্যের চালান আটকে আছে। এগুলো ছাড়াতে যে টাকার প্রয়োজন সেটা সরকারের নেই। তবে দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী ফাদিলা রাভি বলেছেন, শস্যের ওই চালান ছাড়ে দেরি হওয়ার কারণ শ্রকিক ধর্মঘট। আর যে পরিমাণ শস্য মজুদ আছে তা দিয়ে মে মাস পর্যন্ত চলা যাবে।
এছাড়া চিনি ও সুজির মতো আরও যেসব পণ্যে সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে সেগুলোরও যোগান কম। তারেক তাহরি নামে একজন পাইকারি বিক্রেতা বলেন, এগুলো এখন পাওয়া যাচ্ছে না। আগে এগুলো সহজেই পাওয়া যেত। কিন্তু এখন বড় একটা সমস্যা চলছে।
এদিকে সরকার ময়দার দাম না বাড়ালেও বেশ কিছু বিক্রেতা বেশি দামে রুটি বিক্রি শুরু করেছে। এর কারণ হিসেবে বিক্রেতারা বলছেন, তারা সরকারের ভর্তুকি দেওয়া মূল্যে কোথাও ময়দা পাচ্ছেন না, আর তাদের বেশি দামে ময়দা কিনতে হচ্ছে।
ফার্মেসিগুলোতে ডায়াবেটিস ও হার্টের অনেক ওষুধও আর পাওয়া যাচ্ছে না।
ফার্মেসিগুলোতে ওষুধ না পাওয়া একজন ক্রেতা জানিয়েছেন, তিনি ফ্রান্সে এক বন্থুকে বলেছেন তার জন্য ওষুধ পাঠাতে। এ পরিস্থিতি সহ্য করা যায় না। আমরা কোন পথে যাচ্ছি? সাইদ আমাদের যে উন্নয়নের গল্প শুনিয়েছিল এটা সেই উন্নয়ন?
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিউনিসিয়ায় অনেক দিন ধরে চলছে রাজনৈতিক সংকট। এই সংকটের সূত্রপাত ২০১১ সালে। ‘আরব বসন্ত’ নামের গণ-আন্দোলন তখন শুরু হয়েছিল এই দেশ থেকে। পরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ওই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। রক্তক্ষয়ী ওই বিক্ষোভের মুখে তখনকার তিউনিসিয়ার সরকার পতন হলেও সেই বিপ্লবের সুফল পাননি দেশটির জনগণ। দেশটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা টালমাটাল। আর্থিক দুরবস্থা, বেকারত্বসহ নানা কারণে তিউনিসদের মধ্যে হতাশা জেঁকে বসেছে। সম্প্রতি দেশটিতে করোনার সংক্রমণ লাগামছাড়া হওয়ায় সেই হতাশা আরও বেড়ে যায়। ফলে, সরকারের প্রতি মানুষের চরম অনাস্থা জন্মে। করোনার টিকাদান কার্যক্রম নিয়ে তালগোল পাকানোর কারণে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়।
করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতা, দেশের আর্থিক দুরবস্থা ও সামাজিক অসন্তোষের মধ্যে রোববার তিউনিসিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিশাম মেশিশি ও তার দল মধ্যপন্থী ইসলামিক পার্টি এন্নাহদার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করেন হাজার হাজার মানুষ। তাঁদের দাবি, এই সরকার জনগণকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ। তাই তাদের ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৫০
আপনার মতামত জানানঃ