গত ৩০শে জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্য দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের সাপ্তাহিক সাময়িকীতে ছবিসহ সাইফ আল ইসলামের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর থেকে লিবিয়া এবং আরব বিশ্বে শুরু হয়েছে তোলপাড়। গত সাত বছর সাইফ গাদ্দাফির কোনও খোঁজ কেউ পায়নি। তিনি বেঁচে আছেন কি নেই, তা নিয়েও ছিল অনিশ্চিতা।
কয়েক মাস আগে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির দক্ষিণ-পশ্চিমে নাফুশ পার্বত্যাঞ্চলের জিনতান মালভূমি এলাকায় নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রীর সঙ্গে সাইফের দেখা হয়। তাদের সঙ্গে আলাপে সাইফ নিজের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে দীর্ঘ সময় কথা বলেন।
সাংবাদিক এবং লেখক রবার্ট এফ ওয়ার্থকে সাইফ গাদ্দাফি বলেন, “আমি আমার দেশ ফেরত চাই। তারা আমার দেশকে ধর্ষণ করেছে। হাঁটুর ওপর বসিয়েছে। কোনও টাকা পয়সা নেই। জীবনের কোনও স্পন্দন নেই। আপনি গ্যাস স্টেশনে যান, সেখানে ডিজেল নেই। অথচ আমরা ইতালিতে তেল-গ্যাস রপ্তানি করি। ইতালির অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় আমাদের তেল-গ্যাসে। কিন্তু আমার দেশে লোডশেডিং।”
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে দেশে দেশে আরব বসন্তের ঢেউয়ের সময় লিবিয়ার শাসক গাদ্দাফির বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ শুরু হয়। লিবিয়ার নাগরিকদের ‘রক্ষা করার দায়িত্ববোধ’ থেকে নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ায় সামরিক অভিযান অনুমোদন দেয়ার পর মার্কিন সমর্থনপুষ্ট অ্যাংলো-ফ্রেঞ্চ সেনারা দেশটিতে অভিযান শুরু করে।
আমেরিকা, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের বিমান হামলার মুখে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে ২০১১ সালে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছিলেন লিবিয়ার একনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তবে গাদ্দাফির উত্তরসূরী সাইফ আল ইসলাম গাদ্দাফি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। পশ্চিমা বিমান হামলায় গুরুতর আহত অবস্থায় ক’জন সঙ্গী নিয়ে পাশের দেশ নিজারে পালিয়ে যাওয়ার সময় সীমান্তে মরুশহর আওবারি থেকে একদল সশস্ত্র বিদ্রোহীর হাতে ধরা পড়েন তিনি।
তখন থেকেই তিনি ‘জিনতান ব্রিগেড’ নামের ওই মিলিশিয়া গোষ্ঠীর কব্জায়।বএর মধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হয়েছে। ২০১৫ সালে ত্রিপোলির আদালতে তার মৃত্যুদণ্ডও হয়েছে। কিন্তু জিনতান ব্রিগেড কারো কাছেই তাকে হস্তান্তর করেনি।
যদিও এ বিষয়ে সাইফ গাদ্দাফি বলেন, “আমি মুক্ত, এবং রাজনীতিতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি। যে বিদ্রোহীরা আমাকে বন্দী করে রেখেছিল, এখন তারাই আমার প্রধান মিত্র।”
নিউইয়র্ক টাইমসকে সাইফ জানিয়েছেন লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে চান। তিনি বলেন, আমি দশ বছর ধরে লিবিয়ার জনগণ থেকে দূরে রয়েছি। ধীরে ধীরে ফিরে আসতে হবে। জনগণের মন জয় করতে হবে।
সূত্র মতে, দেশকে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে বাঁচাতে সাইফ গাদ্দাফি তার বাবার তৈরি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ‘গ্রিন মুভমেন্ট‘ পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করেছেন। সাইফ গাদ্দাফি এখন বিশ্বাস করেন যে ২০১১ সালের বিপ্লব নিয়ে লিবিয়ার মানুষের মোহভঙ্গ হয়েছে, তারা এখন হতাশ, অনুশোচনা করছে এবং তার বাবার শাসনামল নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভুগতে শুরু করেছে।
আদতে যে দুর্নীতির স্লোগান দিয়ে ২০১১ সালে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, সেই দুর্নীতির বিষয়টি এখনও লিবিয়ার জনগণের প্রধান অভিযোগ। দারিদ্র এবং নিরাপত্তাহীনতা বহুগুণে বেড়েছে। সেই সাথে ক্রমাগত চলছে গৃহযুদ্ধ। এর মধ্যে সাইফ গাদ্দাফির সাক্ষাৎকার নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে লিবিয়া ও আরব বিশ্বে।
২০১৪ সালের পর সাইফ গাদ্দাফির কোন ছবি বা ভিডিও বের হয়নি। ফলে অনেকে বিভ্রান্ত। সাক্ষাৎকারের সাথে ছাপা লম্বা দাড়িওয়ালা ছবি দেখে অনেকে বলছেন এটা আসল সাইফ ইসলাম না, তার ছোট ভাই। নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা হওয়ার কারণে অনেকে বলছেন এটা আমেরিকার আরেক কারসাজি। যদিও অনেকেই আবার উৎফুল্ল।
এদিকে, লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাদি হামদি বিবিসি বাংলাকে বলেন, নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সাইফ গাদ্দাফির বক্তব্যে তিনি বিস্মিত হননি। কারণ গত কয়েক বছর ধরে কখনও গোপনে কখনও প্রকাশ্যে লিবিয়াতে সাইফ গাদ্দাফিকে নিয়ে কথা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “জিনতানে যে মিলিশিয়া গ্রুপটি তাকে ধরে রেখেছিল তারা কখনই ত্রিপোলি সরকারের শত চাপেও তাকে হস্তান্তর করেনি। এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতের চাপও কাজ করেনি। তারা হয়ত বুঝেছে কোনও না কোনও সময়ে সাইফের রাজনৈতিক মূল্য তৈরি হবে এবং তারা সেটাকে তাদের পক্ষে কাজে লাগাতে পারবে।”
মি হামদি বলেন, ‘আরব বসন্ত‘ যেসব দেশে সফল হয়েছিল সেগুলো একে একে আবার একনায়কদের হাতে চলে যাচ্ছে। তিউনিসিয়ায় গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হচ্ছে। সাইফ আল ইসলাম এগুলো দেখছেন এবং তিনি হয়তো সত্যিই মনে করছেন লিবিয়ার জনগণ তার বাবার আমলে ফিরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। কোনও সন্দেহ নেই লিবিয়ানরা গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত, গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতির ছিটেফোঁটা বাস্তবায়নও তারা দেখেননি। এখন তারা অন্তত স্থিতিশীলতা চান।”
গণতন্ত্রের চাইতে লিবিয়ায় স্থিতিশীলতা এখন সবার কাম্য। লিবিয়ার সাধারণ জনগণ, বাইডেন, ইউরোপ, পুতিন সবাই এ নিয়ে উদগ্রীব। স্থিতিশীলতার সেই ভরসা গাদ্দাফি পুত্র দিতে পারবেন কিনা, তা এখনও কেউ জানে না। তার মাঠে না নামার আগে এটা বোঝা এখনও শক্ত।
যদিও ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে কোনওরকম প্রাণে বেঁচে ১০ বছর উধাও থাকার পর ক্ষমতার রাজনীতিতে ফেরা একেবারেই সহজ হবে না সাইফ গাদ্দাফির জন্য। এই দশ বছরে যে সব মানুষ শক্তিধর হয়েছে, ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করছে তারা আরেকজনকে, বিশেষ করে গাদ্দাফি পরিবারের কাউকে, সেই ক্ষমতায় ভাগ বসাতে দিতে চাইবে না। এছাড়া সাইফ গাদ্দাফির উত্থান রাশিয়া, তুরস্ক, মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপর অনেকটা নির্ভর করবে।
রাশিয়ার সাথে বেশ কিছুদিন ধরে সাইফ গাদ্দাফির যোগাযোগ চলছে বলে ইঙ্গিত রয়েছে উল্লেখ করে সামি হামদি বলেন, “বছর দেড়-দুই আগে এমন খবরও বেরিয়েছে যে কীভাবে জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব, তা নিয়ে সাইফ গাদ্দাফি রাশিয়ার হাতে একটি ব্লু-প্রিন্ট তুলে দেন। এমন খবরও শোনা গেছে, রাশিয়া নিজ থেকে গোপনে সাইফের জনসমর্থন যাচাইও করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “তুরস্কের সাথে গাদ্দাফি সরকারের ভালো সম্পর্ক ছিল। স্বার্থসিদ্ধি হলে তুরস্ক মিত্র বদলাতে পারে, সে নজীর রয়েছে। ইউএই এবং মিশর চায় লিবিয়ায় যেন রাজনৈতিক ইসলাম ঘাঁটি গাড়তে না পারে। সাইফ ইসলাম অবশ্যই মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক নন।”
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭২৬
আপনার মতামত জানানঃ